অর্ধাঙ্গী প্রবন্ধের সৃজনশীল প্রশ্নের উত্তর : বাংলা অঞ্চলের মুসলমান সমাজে নারী জাগরণের পথিকৃৎ রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন অন্তঃপুরবাসিনী জীবন শুরু করলেও সামাজিক সীমাবদ্ধতার বেড়াজাল অতিক্রম করে বিদ্যাচর্চায়, শিক্ষা সংগঠনে ও সামাজিক অগ্রগতি সাধনে বরণীয় ও স্মরণীয় হয়ে আছেন। তিনি বিরাট ঝুঁকি নিয়ে অবরোধবাসিনীদের উন্মুক্ত বিশ্বে পদার্পণ করার যে আহ্বান জানিয়েছিলেন, তা আমাদের সমাজজীবনে আজ সার্থকতা লাভ করেছে। মুসলমান মেয়েদের শিক্ষার জন্য স্কুল প্রতিষ্ঠা তাঁর অসাধারণ কীর্তি। সমস্ত প্রতিকূলতার ভিতরেও আপন উদ্যম ও প্রচেষ্টায় রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন ইংরেজি ও বাংলা ভাষায় যে দক্ষতা অর্জন করেছিলেন তা বিস্ময়কর। রোকেয়া সাখাওয়াত হেসেন বাংলা সাহিত্যে বেগম রোকেয়া নামে বিশেষ পরিচিত।’
অর্ধাঙ্গী প্রবন্ধের সৃজনশীল প্রশ্নের উত্তর
সমাজসেবা ব্রত হলেও রোকেয়া কলম ধরেছিলেন সমাজকে জাগানোর লক্ষ্যে এবং এভাবেই তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছেন তীক্ষ্ণ, ঋজু, যুক্তিনিষ্ঠ গদ্যলেখক এবং সমাজসচেতন সাহসী সাহিত্যিক হিসেবে। ঠিক বেগম রোকেয়ার তুল্য লেখক তৎকালীন হিন্দু বা মুসলমান, নারী বা পুরুষ আর কেউ ছিলেন না- বেগম রোকেয়া এমনই এক অদ্বিতীয় রচনারীতির অধিকারী ছিলেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হচ্ছে: ‘পদ্মরাগ’, ‘অবরোধবাসিনী’, ‘মতিচুর’, ‘সুলতানার স্বপ্ন’ ইত্যাদি। ইংরেজি গ্রন্থ ‘Sultana’s Dream’ও তাঁরই রচনা। বেগম রোকেয়ার লেখা প্রকাশিত হতো ‘মিসেস আর. এস. হোসেন’ নামে। বেগম রোকেয়ার জন্ম ১৮৮০ খ্রিষ্টাব্দে রংপুর জেলার মিঠাপুকুর থানার পায়রাবন্দ গ্রামে। তাঁর মৃত্যু ১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দে।
পাঠ-পরিচিতি
বেগম রোকেয়ার ‘অর্ধাঙ্গী’ প্রবন্ধে উনিশ শতকের শেষ ও বিশ শতকের গোড়ায় ভারতবর্ষে পুরুষশাসিত সমাজজীবনের সবক্ষেত্রে নারী, বিশেষ করে মুসলমান নারী সমাজের পশ্চাদপদতা, দুর্বহ জীবন ও অধিকারহীনতাকে দেখানো হয়েছে পুরুষের নিদারুণ স্বার্থপরতা ও আধিপত্যকামী মানসিকতার প্রেক্ষাপটে। অত্যন্ত ব্যথিত হৃদয়ে বেগম রোকেয়া আবেগধর্মী যুক্তিপ্রধান এই রচনায় নারীসমাজকে জ্ঞানচর্চা ও কর্মব্রত, অধিকার সচেতনতা ও মুক্তি আকাঙ্ক্ষায় আকৃষ্ট করতে সচেষ্ট হয়েছেন। তিনি দেখাতে চেয়েছেন, সমাজ যে পূর্ণ ও স্বাভাবিক গতিতে অগ্রসর হতে পারছে না তার কারণ পরিবার ও সমাজজীবনের অপরিহার্য অর্ধেক শক্তি নারীসমাজের দুর্বল ও অবনত অবস্থা। এজন্য পুরুষসমাজের দৃষ্টিভঙ্গির সংকীর্ণতাকে দায়ী করেছেন তিনি।
এই রচনায় তিনি নারীজাগরণের পক্ষে যে সুচিন্তিত, দৃঢ় ও বলিষ্ঠ মতামত ব্যক্ত করেছেন তাতে তাঁর মন্তব্যে আছে আবেগের গাঢ়তা আর যুক্তিতে আছে তীক্ষ্ণতা। তিনি দেখাতে চেয়েছেন, সমাজজীবনের অগ্রগতি ও কল্যাণসাধনের জন্যে নারীজাগরণ এবং সেই সঙ্গে পুরুষ সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের কোনো বিকল্প নেই।
অর্ধাঙ্গী প্রবন্ধের সৃজনশীল প্রশ্নের উত্তর
১. রেণু ও রাজু একই পিতা-মাতার সন্তান। কিন্তু তাদের পিতা-মাতা রাজুকে রেণু অপেক্ষা বেশি আদর-যত্ন করে। দুই ভাইবোন খেতে বসলে বড় ভাগটা রাজু পায়। রাজু কোনো অপরাধ করলে তাদের পিতা-মাতা বেটা ছেলে বলে আমলে নেয় না। রাজুর জন্য গৃহশিক্ষক থাকলেও রেণুর জন্য তা রাখা হয়নি। রেণু যতই বয়ঃপ্রাপ্ত হচ্ছে পিতা-মাতা তার বিয়ে দেওয়ার জন্য ততই ব্যাকুল হয়ে উঠেছে। এতে রেণু আপত্তি করলে তার মা বলেন, মেয়েদের এত লেখাপড়া শিখে কাজ নেই, বরং ঘর-দোর সাজানো গোছানো, সুয়েটার বুনন এবং রান্না করাটা শিখে নিলে তা কাজে আসবে।
ক. ‘শমস-উল-ওলামা’ অর্থ কী?
খ. ‘স্বামী’র স্থলে ‘অর্ধাঙ্গ’ শব্দটি প্রচলিত হওয়ার যৌক্তিকতা বর্ণনা কর।
গ. অনুচ্ছেদে রেণুর পরিবারে নারীর যে অবস্থাটি ফুটে উঠেছে তা ‘অর্ধাঙ্গী’ প্রবন্ধের আলোকে ব্যাখ্যা কর।
ঘ. ‘অনুচ্ছেদে রেণুর মায়ের মনোভাব সমকালীন প্রতিক্রিয়াশীল সমাজের মনোভাবেরই সমান্তরাল’-মন্তব্যটি ‘অর্ধাঙ্গী’ প্রবন্ধের আলোকে বিশ্লেষণ কর।
১ নম্বর সৃজনশীল প্রশ্নের উত্তর
ক. ‘শমস-উল-ওলামা’ একটি আরবি শব্দসমষ্টি, যার বাংলা অর্থ ‘জ্ঞানীদের সূর্য’। এই শব্দটি সাধারণত বিশেষভাবে কোনো বিদ্যাবিজ্ঞানে অত্যন্ত জ্ঞানী বা বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিকে বোঝাতে ব্যবহৃত হয়।
খ. ‘স্বামী’র স্থলে ‘অর্ধাঙ্গ’ শব্দটি প্রচলিত হওয়ার যৌক্তিকতা হলো, এটি স্ত্রীর সমান মর্যাদা এবং অধিকারকে তুলে ধরে। ‘অর্ধাঙ্গ’ শব্দটি স্বামী-স্ত্রী সম্পর্ককে সহযোগিতামূলক এবং সমতাভিত্তিক হিসেবে দেখায়, যেখানে দুইজনই একে অপরের পরিপূরক অংশ। এটি পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বেরিয়ে গিয়ে নারীর গুরুত্ব ও সমান মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে সহায়ক। ফলে, ‘অর্ধাঙ্গ’ শব্দটি সমাজে সমতার প্রতি একটি ধাপে ধাপে পরিবর্তন আনার প্রমাণ।
গ. ‘অর্ধাঙ্গী’প্রবন্ধের আলোকে রেণুর পরিবারে নারীর যে অবস্থাটি ফুটে উঠেছে তা মূলত পুরুষতান্ত্রিক সমাজের প্রতিচ্ছবি। অনুচ্ছেদে দেখা যাচ্ছে, রেণুর পিতা-মাতা তার ভাই রাজুকে বেশী আদর-যত্ন করেন এবং তার উপর সব ধরনের সুবিধা প্রদান করেন। যেমন, রাজুর জন্য গৃহশিক্ষক রাখা হলেও রেণুর জন্য তা রাখা হয়নি। রাজু কোন ভুল করলে তাকে কোনো শাস্তি দেওয়া হয় না, অথচ রেণুর বিয়ের জন্য তার পিতা-মাতা খুব তাড়াহুড়ো করছেন। তার মায়ের ধারণা, মেয়েদের লেখাপড়া শিখে কোনো কাজ নেই, বরং ঘর-দোর সাজানো, রান্না ও সুয়েটার বুনন শেখাটাই মেয়েদের আসল কাজ।
এটি পুরুষতান্ত্রিক সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি প্রদর্শন করে, যেখানে নারীদের শিক্ষা বা কর্মজীবনের প্রতি কোন গুরুত্ব দেওয়া হয় না, বরং তাদের জীবনকে কেবলমাত্র সংসারী দায়িত্বের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা হয়। ‘অর্ধাঙ্গী’ প্রবন্ধে নারীর সমান মর্যাদা এবং অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে, কিন্তু রেণুর পরিবারের দৃষ্টিভঙ্গিতে তা প্রতিফলিত হচ্ছে না। রেণুকে কেবল তার সামাজিক এবং বৈবাহিক ভূমিকা পালনে বাধ্য করা হচ্ছে, যা নারীর আসল ক্ষমতা ও স্বাধীনতার প্রতি অগ্রহণযোগ্য মনোভাবের পরিচায়ক। এভাবে নারীদের শুধুমাত্র গৃহস্থালি কাজে নিয়োজিত করার ধারণা, নারীর অর্ধাঙ্গী হওয়ার ভাবনার সাথে সংগতিপূর্ণ নয়।
ঘ. ‘অর্ধাঙ্গী’প্রবন্ধের আলোকে রেণুর মায়ের মনোভাব সমকালীন প্রতিক্রিয়াশীল সমাজের মনোভাবেরই সমান্তরাল—এ মন্তব্যটি সঠিক এবং তা সমাজের পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি ও নারীর প্রতি অবমূল্যায়নের বাস্তব প্রতিফলন। প্রবন্ধে নারীর স্বাধীনতা, শিক্ষা, এবং ক্ষমতায়নের কথা বলা হয়েছে, যেখানে নারীদের ব্যক্তিত্ব, পছন্দ এবং মতামতকে সম্মান জানানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু রেণুর মায়ের মনোভাব ঠিক এর বিপরীত।
এখানে রেণুর মা মনে করেন, মেয়েদের লেখাপড়া শিখে কোনো কাজ নেই এবং তাদের মূল কর্তব্য ঘর-দোর সাজানো, রান্না করা এবং সুয়েটার বুনন। এটি পুরুষতান্ত্রিক সমাজের যে ধারণা, যেখানে মেয়েদের কাজ কেবলমাত্র সংসারী দায়িত্বের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে, সেই ধারণারই প্রতিফলন। নারীদের গৃহস্থালির কাজ শিখিয়ে এবং বিয়ে দিয়ে তাদের জীবন গড়ার কথা ভাবা হয়, কিন্তু তাদের ব্যক্তিগত স্বপ্ন, শিক্ষা, বা আত্মবিশ্বাসের মূল্য দেওয়া হয় না।
এমন একটি মনোভাব সমাজে নারীদের কেবলমাত্র ‘অর্ধাঙ্গী’ হিসেবে দেখার ফলস্বরূপ সৃষ্টি হয়। নারীরা নিজেদের স্বাভাবিক এবং পূর্ণাঙ্গ মানুষের মতো বাঁচতে পারে না, কারণ তাদের জীবনের লক্ষ্য সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী নির্ধারিত হয়। ‘অর্ধাঙ্গী’প্রবন্ধে বর্ণিত নারীর স্বাধীনতা, শিক্ষা, এবং সমাজে সমান অধিকার পাওয়ার কথা বিপরীতভাবে তুলে ধরা হয়েছে।
রেণুর মায়ের মনোভাবও সমাজে নারীর ক্ষমতায়ন, স্বাধীনতা এবং অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের বিরুদ্ধে একটি প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করে। এভাবেই, তার মা ও সমাজের পুরনো দৃষ্টিভঙ্গি একই সুত্রে গাঁথা—যেখানে নারীর ভূমিকা কেবলমাত্র একটি সংসারী ভূমিকা, এবং নারীর আত্মনির্ভরশীলতা বা স্বপ্নপূরণের কথা কখনোই গুরুত্ব পায় না।
২. শিশির এক মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করে। বালিকা বয়সে তার স্কুলে যাওয়ার খুব শখ থাকলেও সে পারিবারিক শাসন ডিঙিয়ে স্কুলে যেতে পারেনি। মায়ের কাছে সে আরবি বর্ণমালা শিখেছে। এরপর কায়দা শিখে যখনই আমপারা শিখতে শুরু করে তখনই তার বিয়ের প্রস্তাব আসে। তার পিতা-মাতা কালবিলম্ব না করে মেয়ের বিয়ে দেয়। ভাগ্যগুণে শিশির ভালো স্বামী পেয়ে যায়। সে স্বামীর সংসারে থেকে নিজের প্রচেষ্টা ও স্বামীর উৎসাহে বিদ্যা অর্জন করে। তাতে সে সমাজে নারীর হীন অবস্থা বুঝতে পারে। নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য সে নারীশিক্ষা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে তার এলাকার নারীদের শিক্ষিত করে তোলে।
ক. ‘অবরোধ প্রথা’ কী?
খ. ‘অর্ধাঙ্গী’ প্রবন্ধে লেখক কোন প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ‘নবদম্পতির প্রেমালাপ’ কবিতাংশটি ব্যবহার করেছেন? বর্ণনা কর।
গ. উদ্দীপকে শিশিরের পিতৃ-পরিবারে ব্যক্ত নারীর প্রতি মানোভাব ‘অর্ধাঙ্গী’ প্রবন্ধের আলোকে ব্যাখ্যা কর।
ঘ. শিশিরের কাজের মধ্যে ‘অর্ধাঙ্গী’ প্রবন্ধের প্রাবন্ধিকের ইচ্ছার কি কোনো প্রতিফলন ঘটেছে? তোমার উত্তরের পক্ষে যুক্তি দাও।
◉ আরও দেখ: একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির সকল গল্প-কবিতার CQ-MCQ সমাধান
শিক্ষার্থীরা, উপরে একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির বাংলা মূল বই থেকে অর্ধাঙ্গী প্রবন্ধের সৃজনশীল প্রশ্নের উত্তর আলোচনা করা হয়েছে। একই সাথে পরীক্ষা প্রস্তুতির জন্য আরও অতিরিক্ত ৪টি প্রশ্ন দেওয়া হয়েছে। সবগুলো সৃজনশীল প্রশ্নের উত্তর পিডিএফ আকারে সংগ্রহের জন্য উপরে ‘ANSWER SHEET’ অপশনে ক্লিক করো।
Discussion about this post