আদুভাই গল্পের বর্ণনামূলক প্রশ্ন উত্তর : আদু মিয়া ওরফে আদুভাই ক্লাস সেভেনে পড়তেন। স্কুলে তিনি ছিলেন নিয়মিত, চাল চলন ও আচার-আচরণে ছিলেন সবার প্রিয়। কিন্তু পরীক্ষায় পাশ করতে পারতেন না। তাঁর সহপাঠীদের অনেকে স্কুলের শিক্ষক পর্যন্ত হয়েছেন কিন্তু আদুভাই আর প্রমোশন পাননি। তাঁর ধারণা, ভালোভাবে পড়াশোনা করে তবেই না প্রমোশন। তাই তিনি পরীক্ষার উত্তরপত্রে নিজের মতো উত্তর করতেন, কখনো প্রশ্নও জুড়ে দিতেন। ফলে প্রমোশনও তাঁর মিলত না।
কিন্তু আদুভাইয়ের ছেলে যখন অন্য একটা স্কুলে ক্লাস সেভেন পাশ করতে যাচ্ছে, তখন তিনি প্রমোশনের জন্য মরিয়া হয়ে উঠলেন। এবার তিনি শুরু করলেন কঠোর পরিশ্রম। পরিশ্রমের ধকলে ভয়ানক অসুস্থ হয়ে পড়লেন। শেষ পর্যন্ত অসুস্থ অবস্থায় আদুভাই পরীক্ষায় অংশ নিয়ে ক্লাস সেভেন থেকে এইটে প্রমোশন পেলেন ঠিকই, তবে প্রমোশনের আনন্দ উদ্যাপনের দিনই তিনি মারা গেলেন।
আদুভাই গল্পের বর্ণনামূলক প্রশ্ন উত্তর
বর্ণনামূলক প্রশ্ন—১: নিচের ক ও খ প্রশ্ন দুটির উত্তর দাও :
ক. কীসের জন্য আদুভাইকে দুটি পুরষ্কার দেওয়া হয়েছিল?
খ. শিক্ষকেরাও আদুভাইকে আদুভাই বলে ডাকতেন কেন?
১ নম্বর বর্ণনামূলক প্রশ্নের উত্তর
ক. আদুভাইকে মূলত দুটি বিশেষ গুণের জন্য পুরস্কৃত করা হতো। প্রথমত, সে ছিল অত্যন্ত নিয়মিত ছাত্র। ঝড়-বৃষ্টি, প্রতিকূল আবহাওয়া বা শারীরিক অসুস্থতা কোনো কিছুই তাকে স্কুলে আসা থেকে বিরত রাখতে পারত না। শহরতলীর এক পাড়াগাঁ থেকে প্রতিদিন পাঁচ মাইল পথ হেঁটে সে স্কুলে আসত। এমনকি, প্রাকৃতিক দুর্যোগের দিনেও যখন শিক্ষকরা পর্যন্ত ছাত্রদের অনুপস্থিতির ব্যাপারে নিশ্চিত ছিল, তখনও আদুভাইকে স্কুলে উপস্থিত থাকতে দেখা যেত।
দ্বিতীয়ত, আদুভাই ছিল অত্যন্ত সচ্চরিত্রের অধিকারী। তার মধ্যে কোনো নেতিবাচক বৈশিষ্ট্য ছিল না। সে কখনো মিথ্যা কথা বলত না, কারো সাথে খারাপ ব্যবহার করত না এবং সর্বদা শান্ত ও ভদ্র আচরণ করত। তার এই সচ্চরিত্রের কারণেই সে শিক্ষকদের কাছেও অত্যন্ত প্রিয় ছিল। এই দুটি বিশেষ গুণের কারণেই আদুভাই প্রতি বছর স্কুলের বার্ষিক পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে নিয়মিতভাবে পুরস্কৃত হত।
খ. শিক্ষকদের আদুভাইকে ‘আদুভাই’ বলে ডাকার পেছনের কারণটি বেশ মজার এবং একই সাথে কিছুটা দুঃখজনক। আদুভাই ছিল সেই ছাত্র, যে বছরের পর বছর ধরে একই শ্রেণিতে, অর্থাৎ সপ্তম শ্রেণিতে আটকে ছিল। তার এই দীর্ঘ সময় ধরে একই শ্রেণিতে থাকার কারণে সে যেন সেই শ্রেণির স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে গিয়েছিল।
শিক্ষকদের অনেকে আদুভাইকে ‘আদুভাই’ বলে ডাকতেন, কারণ তাদেরও একসময় আদুভাইয়ের মতো একই অবস্থা ছিল। গল্পে বলা হয়েছে, শিক্ষকরাও এককালে আদুভাইয়ের সহপাঠী ছিলেন এবং সবাই নাকি ক্লাস সেভেনেই আদুভাইয়ের সঙ্গে পড়েছেন। এই তথ্যটি থেকে বোঝা যায়, আদুভাই শুধু ছাত্রদের মধ্যেই নয়, শিক্ষকদের মধ্যেও একটি পরিচিত এবং স্থায়ী নাম ছিল।
আদুভাইয়ের এই দীর্ঘ সময় ধরে একই শ্রেণিতে থাকার বিষয়টি তার সহপাঠী এবং শিক্ষকদের মধ্যে এক ধরনের হাস্যরস সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু আদুভাই নিজে এই বিষয়টিকে সহজভাবে নিয়েছিল। সে কখনো হতাশ হয়নি এবং সবসময় পড়াশোনার প্রতি মনোযোগী ছিল। তার এই ইতিবাচক মনোভাব এবং দীর্ঘ সময় ধরে একই শ্রেণিতে থাকার কারণে শিক্ষকরাও তাকে স্নেহ ও মজার ছলে ‘আদুভাই’ বলে ডাকতেন।
বর্ণনামূলক প্রশ্ন—২: নিচের ক ও খ প্রশ্ন দুটির উত্তর দাও :
ক. ‘মৌলবি সাব আদুভাইয়ের নাম শুনে জ্বলে উঠলেন।’—কেন?
খ. আদুভাইয়ের অপরাধীর ন্যায় উদ্বেগ কম্পিত হওয়ার কারণ কী? ব্যাখ্যা কর।
২ নম্বর বর্ণনামূলক প্রশ্নের উত্তর
ক. মৌলবি সাব আদুভাইয়ের নাম শুনে জ্বলে ওঠার কারণ ছিল আদুভাইয়ের পরীক্ষার খাতায় অদ্ভুত সব কাণ্ড। আদুভাই ফারসি পরীক্ষায় খাতায় কোনো ফারসি হরফ না লিখে বাংলায় নানা কথা লিখেছিল। আদুভাইয়ের এই ‘বেয়াদবি’ দেখে মৌলবি সাব খুবই ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন।
গল্পের বর্ণনাকারী যখন আদুভাইয়ের প্রমোশনের জন্য মৌলবি সাবের কাছে সুপারিশ করতে যায়, তখন মৌলবি সাব আদুভাইয়ের নাম শুনেই রেগে যান। তিনি আদুভাইকে ‘বেতমিজ’ ও ‘খোদার না-ফরমান বান্দা’ বলে অভিহিত করেন। আদুভাইয়ের পরীক্ষার খাতা খুলে দেখা যায়, সে ফারসি ভাষার বদলে বাংলায় অনেক কিছু লিখেছিল। আদুভাইয়ের এই আচরণে মৌলবি সাব এতটাই ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন যে, তিনি আদুভাইকে কোনো নম্বর দিতেও রাজি ছিলেন না।
খ. আদুভাইয়ের অপরাধীর ন্যায় উদ্বেগ কম্পিত হওয়ার মূল কারণ ছিল তার পারিবারিক ও সামাজিক পরিস্থিতি। আদুভাই দীর্ঘদিন ধরে একই শ্রেণিতে থাকার কারণে তার স্ত্রী বিরক্ত ছিলেন এবং আদুভাইয়ের ছেলে যখন সেই একই শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়, তখন বিষয়টি আরও জটিল হয়ে ওঠে। আদুভাইয়ের স্ত্রী তাকে স্পষ্ট জানিয়ে দেন, হয় তাকে এবার প্রমোশন পেতে হবে, নয়তো পড়াশোনা ছেড়ে দিতে হবে। আদুভাইয়ের জন্য পড়াশোনা ছিল জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ, তাই সে পড়াশোনা ছেড়ে দেওয়ার কথা কল্পনাও করতে পারছিল না। কিন্তু একই সাথে সে তার স্ত্রীর ইচ্ছাকেও উপেক্ষা করতে পারছিল না। আদুভাইয়ের ছেলে একই শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হওয়ায় সমাজের চোখে বিষয়টি দৃষ্টিকটু হয়ে ওঠে এবং আদুভাই সামাজিক লজ্জার ভয়ে ভীত ছিল। স্ত্রীর অসন্তোষ আদুভাইয়ের পারিবারিক জীবনে অশান্তি সৃষ্টি করে, তাই সে পারিবারিক শান্তি বজায় রাখতে উদ্বিগ্ন ছিল।
আদুভাইয়ের জীবনে এটি একটি বড় সংকট ছিল এবং সে একদিকে পড়াশোনা ছাড়তে চায়নি, অন্যদিকে স্ত্রীর ইচ্ছাও উপেক্ষা করতে পারছিল না। এই সমস্ত কারণে আদুভাই অপরাধীর মতো সংকোচ ও উদ্বেগে ভুগছিল।
বর্ণনামূলক প্রশ্ন—৩: নিচের ক ও খ প্রশ্ন দুটির উত্তর দাও :
ক. ‘বাবার ইচ্ছে মতোই ওর ব্যবস্থা করা হয়েছে’—উক্তিটি ব্যাখ্যা কর।
খ. ‘আদুভাই’ গল্পের মূলভাব আলোচনা করো।
৩ নম্বর বর্ণনামূলক প্রশ্নের উত্তর
ক. ‘বাবার ইচ্ছে মতোই ওর ব্যবস্থা করা হয়েছে’—উক্তিটি আদুভাইয়ের পুত্র তার বাবার অন্তিম ইচ্ছা পূরণের কথা বোঝাতে ব্যবহার করেছে। আদুভাই সারা জীবন একই ক্লাসে পড়ে থেকেছে। তার জীবনের শেষ ইচ্ছা ছিল অন্তত একবারের জন্য হলেও পরের ক্লাসে উত্তীর্ণ হওয়া। তার এই ইচ্ছা পূরণ হওয়ার পর সে তার পুত্রকে নির্দেশ দিয়েছিল, তার প্রমোশন লাভের ঘটনাটি যেন সবাই জানতে পারে।
গল্পের শেষে দেখা যায়, আদুভাইয়ের পুত্র তার বাবার কবরের ওপর একটি মার্বেল পাথরের ফলক স্থাপন করেছে, যেখানে লেখা রয়েছে, “Here sleeps Adu Mia who was promoted from Class VII to Class VIII.” অর্থাৎ—এখানে আদু মিয়া শায়িত আছেন, যিনি সপ্তম শ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। এই ফলকটি আদুভাইয়ের শেষ ইচ্ছার প্রতিফলন। আদুভাই চেয়েছিলেন, তার প্রমোশন লাভের ঘটনাটি যেন চিরস্মরণীয় হয়ে থাকে। তাই তার পুত্র তার ইচ্ছানুসারে কবরের ওপর এই বিশেষ ফলকটি স্থাপন করেছে।
এই উক্তিটি আদুভাইয়ের জীবনের একটি করুণ পরিণতিকে তুলে ধরে। সে সারা জীবন শিক্ষার প্রতি একনিষ্ঠ ছিল, কিন্তু সমাজের চোখে সে ছিলেন একজন ব্যর্থ মানুষ। তার শেষ ইচ্ছাটি পূরণ হওয়ার মাধ্যমে সে যেন সমাজের কাছে প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন, সে একজন সফল মানুষ ছিল।
খ. আবুল মনসুর আহমদ রচিত ‘আদুভাই’ গল্পটি শিক্ষা ব্যবস্থার ত্রুটি, মানবিক মূল্যবোধ এবং সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির একটি ব্যঙ্গাত্মক চিত্র তুলে ধরে। গল্পের মূল চরিত্র আদুভাই, যে বছরের পর বছর ধরে একই শ্রেণিতে, অর্থাৎ সপ্তম শ্রেণিতে আটকে থাকে। তার এই দীর্ঘ সময় ধরে একই শ্রেণিতে থাকার কারণে সে যেন সেই শ্রেণির স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে যায়।
আদুভাই নিয়মিত স্কুলে আসে, শিক্ষকদের প্রতিটি কথা মনোযোগ দিয়ে শোনে এবং সচ্চরিত্রের অধিকারী। কিন্তু সে পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করতে পারে না। ফলে, সে বছরের পর বছর একই শ্রেণিতে থেকে যায়। তার এই অসাফল্যে অনেকেই হতাশ হলেও আদুভাই কখনো বিষন্ন হয় না। সে বিশ্বাস করে, একদিন সে সব বিষয়ে ‘পাকা’ হয়ে উঠবে এবং প্রমোশন তার কেউ ঠেকাতে পারবে না।
গল্পের বর্ণনাকারী, যিনি আদুভাইয়ের সহপাঠী, সে আদুভাইয়ের সরলতা এবং জ্ঞানের প্রতি আগ্রহ দেখে মুগ্ধ হন। তারা দুজন বন্ধু হয়ে ওঠেন। বর্ণনাকারী যখন ম্যাট্রিক পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন, তখনও আদুভাই সপ্তম শ্রেণিতেই অবস্থান করছেন।
একদিন আদুভাই বর্ণনাকারীর কাছে প্রমোশনের জন্য সাহায্য চান। তার স্ত্রী তাকে জানিয়ে দিয়েছেন, হয় তাকে এবার প্রমোশন পেতে হবে, নয়তো পড়াশোনা ছেড়ে দিতে হবে। আদুভাইয়ের ছেলে যখন সেই একই শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়, তখন বিষয়টি আরও জটিল হয়ে ওঠে।
বর্ণনাকারী আদুভাইয়ের হয়ে শিক্ষকদের কাছে সুপারিশ করতে যান। কিন্তু আদুভাইয়ের পরীক্ষার খাতায় অদ্ভুত সব কাণ্ড দেখে শিক্ষকরা তাকে প্রমোশন দিতে রাজি হন না। আদুভাই তখন নিজেই হেডমাস্টারের কাছে যান এবং প্রমোশনের জন্য অনুরোধ করেন।
শেষ পর্যন্ত আদুভাই প্রমোশন পান। কিন্তু প্রমোশনের জন্য সে এতটাই পরিশ্রম করেন যে, সে অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং মারা যান। তার মৃত্যুর পর তার কবরের ওপর একটি মার্বেল পাথরের ফলক স্থাপন করা হয়, যেখানে লেখা থাকে, “এখানে আদু মিয়া শায়িত আছেন, যিনি সপ্তম শ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন।”
‘আদুভাই’ গল্পটি একদিকে যেমন হাস্যরসাত্মক, তেমনি অন্যদিকে গভীর সামাজিক বার্তা বহন করে। এটি আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা এবং সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে পুনর্বিবেচনা করতে অনুপ্রাণিত করে।
আরও দেখো—ষষ্ঠ শ্রেণির বাংলা গল্প-কবিতার সৃজনশীল প্রশ্ন উত্তর
শিক্ষার্থীরা, উপরে তোমাদের আনন্দপাঠ বই থেকে আদুভাই গল্পের বর্ণনামূলক প্রশ্ন উত্তর নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। তোমাদের পরীক্ষা প্রস্তুতির জন্য ৩টি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন এখানে দেওয়া হয়েছে। এ প্রশ্নগুলো খুব ভালোভাবে অনুশীলন করার পরামর্শ থাকবে। পিডিএফ ফরমেটে উত্তরমালা সংগ্রহের জন্য ‘Answer Sheet’ অপশনে ক্লিক করো। এছাড়াও বাংলা বইয়ের গল্প-কবিতার সৃজনশীল, জ্ঞানমূলক, অনুধাবনমূলক এবং বহুনির্বাচনি সমাধানের জন্য উপরের লিংকটি অনুসরণ করো।
Discussion about this post