আলাউদ্দিনের চেরাগ গল্পের বর্ণনামূলক প্রশ্ন উত্তর : নিশানাথবাবু গণিতের অবসরপ্রাপ্ত স্কুল-শিক্ষক। চোখে কম দেখেন। স্ত্রী-সন্তান বেঁচে না-থাকায় তিনি নিঃসঙ্গ একজন মানুষ। একদিন তাঁর ছেঁড়া চটির পেরেক উঁচু হয়ে যাওয়ায় চটিজোড়া ব্যবহারে অসুবিধা হচ্ছিল। পরে ঘরের জঞ্জাল থেকে একটা ধাতব পুরোনো চেরাগ খুঁজে পেয়ে সেটা দিয়ে জুতোতে বাড়ি দিতেই আলাউদ্দিনের দৈত্য এসে হাজির হয়। নিশানাথবাবু চাইলেই দৈত্যের কাছ থেকে মূল্যবান অনেক কিছু পেতে পারতেন; কিন্তু তিনি কিছু চাননি। সম্পদের লোভ তাঁকে স্পর্শ করেনি।
তাই তিনি দৈত্যের কাছ থেকে কোনো বাড়তি সুবিধা নিতে রাজি নন। তাঁর প্রাক্তন সহকর্মীরা চাঁদা তুলে তাঁকে সাহায্য করে। সে টাকা নিতেও তিনি লজ্জা পান। দৈত্য স্বেচ্ছায় নিশানাথবাবুকে পরশপাথর দিতে চায়। তা গ্রহণেও তিনি অস্বীকৃতি জানান। এ-গল্পে হুমায়ূন আহমেদ আরব্য-রজনীর গল্পের দৈত্য-চরিত্রের সঙ্গে বাংলাদেশের একজন সাধারণ শিক্ষকের সম্পর্ক দেখান। লেখকের কল্পনাপ্রতিভা ও প্রকাশভঙ্গির নৈপুণ্যে গল্পে উঠে এসেছে একজন নির্লোভ মানুষের ছবি, দারিদ্র্যে যিনি কষ্ট ভোগ করলেও থেকেছেন লোভহীন ও মহৎ।
আলাউদ্দিনের চেরাগ গল্পের বর্ণনামূলক প্রশ্ন উত্তর
বর্ণনামূলক প্রশ্ন—১: নিচের ক ও খ প্রশ্ন দুটির উত্তর দাও :
ক. নিশানাথবাবুর জীবনে সবচেয়ে বড় কষ্ট কী ছিল? এবং তিনি কেন তা সহ্য করে যাচ্ছিলেন?
খ. নিশানাথবাবু প্রথম আলাউদ্দিনের চেরাগের দৈত্যকে কীভাবে চিনতে পারলেন এবং তার প্রতিক্রিয়া কী ছিল?
১ নম্বর বর্ণনামূলক প্রশ্নের উত্তর
ক. নিশানাথবাবুর জীবনে সবচেয়ে বড় কষ্ট ছিল তার শারীরিক অসুস্থতা ও একাকিত্ব।
দুই চোখেই ছানি পড়ায় তিনি প্রায় কিছুই দেখতে পারতেন না, ফলে তার দৈনন্দিন জীবনে অনেক অসুবিধা হচ্ছিল। তিনি নিজেই বলেন যে, তিনি এমন অনেক মানুষ দেখেছেন যারা তার থেকে অনেক বেশি কষ্টে আছে, এবং এই চিন্তা তাকে নিজের কষ্ট সহ্য করার শক্তি দেয়। পাশাপাশি, তার শরীরেও সমস্যা ছিল। বাতের ব্যথা তাকে ভোগাতো, এমনকি হাঁটাচলারও অসুবিধা হচ্ছিল। তিনি একাকী জীবন কাটাচ্ছিলেন, কারণ তার ছেলে-মেয়ে কেউ নেই। স্ত্রীর মৃত্যুর পর তিনি নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন। তার একমাত্র মেয়ে ছোটবেলায় টাইফয়েডে মারা গেছে।
এসব কষ্ট সত্ত্বেও তিনি এইসব সহ্য করছিলেন, কারণ তার মনে ছিল যে তার চাইতে আরও অনেক মানুষ আছেন যারা তার থেকেও বেশি কষ্টে আছেন। এভাবে নিজেকে সান্ত¡না দিয়ে তিনি সব কষ্ট সহ্য করছিলেন। এছাড়া, তিনি মনে করতেন যে তার জীবনের আর বেশিদিন বাঁচার সময় নেই, আর কিছুটা কষ্ট করলেই তো চলে যাবে, তাই খুব বেশি চিন্তা করতেন না। জীবন কাটাতে তিনি এত কষ্টে থেকেও যেন অল্প সময়ের জন্য শান্তি পেতে চেয়েছিলেন।
খ. নিশানাথবাবু প্রথম আলাউদ্দিনের চেরাগের দৈত্যকে তখন চিনতে পারেন যখন তিনি চেরাগের পেরেক দিয়ে ঠক ঠক করে বাড়ি দিয়েছিলেন, যার ফলে কালো ধোঁয়া ঘরটিতে ভরে যায়। নিশানাথবাবু প্রথমে ভেবেছিলেন, হয়তো তার চোখের সমস্যার কারণে তাকে বিভ্রান্তি হচ্ছে, কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যে সেই ধোঁয়া কেটে যায় এবং একটি গম্ভীর গলায় কথা বলতে থাকা দৈত্যের কথা শোনেন। দৈত্য জানায়, সে আলাউদ্দিনের চেরাগের দৈত্য এবং নিশানাথবাবু যে চেরাগটি হাতে নিয়েছেন সেটিই সেই বিখ্যাত চেরাগ। নিশানাথবাবু যখন দৈত্যের বিশাল আকার এবং তার মাথায় দুটি শিং দেখতে পান, তখন তার মধ্যে সন্দেহ আর ভয় একসঙ্গে কাজ করতে থাকে।
প্রথমে তিনি ভয়ে ভয়ে তাকে জিজ্ঞেস করেন, ‘তুমি কে?’ তারপর দৈত্য তার পরিচয় দেয়। নিশানাথবাবু দৈত্যের উপস্থিতি এবং গম্ভীর গলায় কথা বলার কারণে প্রথমে কিছুটা ভীত হয়ে পড়েন, তবে তার পরবর্তী প্রতিক্রিয়া ছিল অবাক হওয়া এবং বিস্মিত হওয়া। তিনি প্রথমে বিশ্বাস করতে পারেননি যে সত্যিই একটি দৈত্য তার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তবে এরপর দৈত্যের মাথায় শিং দেখতে পেয়ে তিনি পুরো বিষয়টি বিশ্বাস করতে শুরু করেন এবং এতে তার অভ্যস্ত জীবনের যান্ত্রিকতার বাইরে এক অদ্ভুত অবস্থা সৃষ্টি হয়।
বর্ণনামূলক প্রশ্ন—২: নিচের ক ও খ প্রশ্ন দুটির উত্তর দাও :
ক. চেরাগের দৈত্যের সঙ্গে নিশানাথবাবুর সম্পর্ক কেমন ছিল?
খ. দৈত্য নিশানাথবাবুকে কোন সুবিধা দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল? নিশানাথবাবু তার প্রস্তাবে কী জবাব দিয়েছিলেন?
২ নম্বর বর্ণনামূলক প্রশ্নের উত্তর
ক. নিশানাথবাবু এবং চেরাগের দৈত্যের সম্পর্ক ছিল একদিকে অবিশ্বাস্য, তবে অন্যদিকে কিছুটা আস্থারও ছিল। প্রথমবার যখন দৈত্য তার সামনে হাজির হয়, তখন নিশানাথবাবু প্রচণ্ড ভয় পেয়ে যান এবং বিশ্বাস করতে চান না যে, সে আসলেই একটি দৈত্য। তবে দৈত্যের কথা এবং তার অদ্ভুত আচরণ থেকে নিশানাথবাবু বুঝতে পারেন যে, এই ঘটনা সত্যি। প্রথমে তিনি দৈত্যের উপস্থিতি নিয়ে সন্দিহান ছিলেন, কিন্তু কিছু সময় পরে দৈত্যের উপকারিতা এবং তার সেবা গ্রহণ করে তিনি তার সঙ্গে একটা সম্পর্ক তৈরি করেন।
দৈত্য নিশানাথবাবুকে সাহায্য করতে চাইলেও, নিশানাথবাবু সবসময় তাকে কোনো কিছু প্রয়োজন ছিল না বলেই জানান। এভাবে, দৈত্যের সঙ্গে নিশানাথবাবুর সম্পর্ক ছিল এক ধরনের দ্বন্দ্বময়—অবিশ্বাসের পাশাপাশি, দৈত্যের সহায়তা গ্রহণে তিনি এক ধরনের অদ্ভুত মিতব্যয়িতার পরিচয় দেন। তার প্রতি দৈত্যের আন্তরিকতা এবং সেবা তাকে কিছুটা অবাক করেছিল, তবে তিনি এই সাহায্য নেয়াতে সংকোচ বোধ করতেন।
খ. দৈত্য নিশানাথবাবুকে অনেক ধরনের সুবিধা দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল।
প্রথমে, দৈত্য তাকে টাকার প্রস্তাব দেয়। সে বলে ‘এক কলসি সোনার মোহর এনে আপনার খাটের নিচে রেখে দেব,’ কিন্তু নিশানাথবাবু এতে আগ্রহী হননি। তিনি বলেন, ‘এত টাকা দিয়ে আমি করব কী? কদিনই-বা বাঁচব।’ এরপর দৈত্য তার কাছে আরো কিছু সুবিধা দেওয়ার প্রস্তাব দেয়, যেমন তাকে ভালো চিকিৎসা দেওয়ার বা পরশপাথর এনে সোনা বানানোর সুযোগ। কিন্তু নিশানাথবাবু সবসময় একে এড়িয়ে চলেন।
তিনি জানান যে তার কোনো কিছুই চাইতে ইচ্ছা নেই, কারণ তার জীবনের এখন অনেক কিছুই অপ্রয়োজনীয় এবং কোনো বিশাল ধনসম্পদ তার জন্য গুরুত্বহীন। দৈত্য যখন মশারি খাটানোর জন্য বলল, তখনও নিশানাথবাবু তাকে প্রস্তাব দেন কিছু না কিছু করতে, কিন্তু তিনি বলেন, ‘আচ্ছা দাও, মাথায় হাত বুলিয়ে দাও, ঘুম হবে আরামদায়ক।’ এইভাবে, দৈত্য নানা সুবিধা দেওয়ার পরেও নিশানাথবাবু তার প্রস্তাবে তেমন আগ্রহ দেখাননি এবং সবসময় নিজেকে সরলভাবে রাখার চেষ্টা করেছেন।
আলাউদ্দিনের চেরাগ হুমায়ুন আহমেদ
বর্ণনামূলক প্রশ্ন—৩: নিচের ক ও খ প্রশ্ন দুটির উত্তর দাও :
ক. দৈত্য নিশানাথবাবুকে যে পরশপাথর উপহার দিয়েছিল, এটি কী কাজ করত?
খ. নিশানাথবাবু মৃত্যুর আগে হেডমাস্টার সাহেবকে কী গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছিলেন এবং কেন তিনি তা গোপন রাখলেন?
৩ নম্বর বর্ণনামূলক প্রশ্নের উত্তর
ক. দৈত্য নিশানাথবাবুকে যে পরশপাথর উপহার দিয়েছিল, তা ছিল একটি বিশেষ অলৌকিক পাথর, যার শক্তি ছিল যে কোনো ধাতুর গায়ে লাগালে সেটি সোনা হয়ে যেত। দৈত্য নিশানাথবাবুকে এটি উপহার দিয়ে বলেছিল যে, এই পাথরটি ব্যবহার করে সে লক্ষ লক্ষ টন সোনা তৈরি করতে পারবে। একসময় দৈত্য পরশপাথরটি নিশানাথবাবুর সামনে দেখিয়ে তার কার্যকারিতা প্রমাণ করেছিল।
যখন দৈত্য পরশপাথরটি একটি বালতির গায়ে লাগাল, তখন তা সোনার মতো ঝকমক করতে শুরু করে। এটি ছিল একটি অমূল্য এবং অত্যন্ত শক্তিশালী বস্তু, যা নিশানাথবাবুকে বড়ো প্রভাবিত করেছিল। তবে, নিশানাথবাবু পরশপাথরটি গ্রহণ করার পরও তাতে বিশেষ আগ্রহ দেখাননি এবং পরে জানিয়েছিলেন যে, তিনি এই ধরনের ধনসম্পদের প্রতি আগ্রহী নন। তার কাছে এমন কোনো জিনিসের প্রয়োজন ছিল না যা তার অন্তরে শান্তি বা সন্তুষ্টি আনতে পারে না।
খ. নিশানাথবাবু মৃত্যুর আগে হেডমাস্টার সাহেবকে এক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছিলেন—তিনি তাকে জানান, তার ঘরে একটি বড়ো বালতি রয়েছে, যা তিনি স্কুলকে উপহার দিতে চান। নিশানাথবাবু চুপচাপ ভাবে হেডমাস্টার সাহেবকে বালতিটি নিতে বলেছিলেন, কিন্তু তিনি কোনোভাবে জানাতে পারেননি যে বালটিটি আসলে সোনার তৈরি। মৃত্যুর আগের মুহূর্তে তার শ্বাসপ্রশ্বাসও খুব অসুস্থ ছিল, এবং তিনি খুবই কষ্টে ছিলেন। নিশানাথবাবু এই তথ্য গোপন রেখেছিলেন কারণ তার কাছে তা ছিল এক প্রকার দায়িত্ববোধের বিষয়—তিনি চাইতেন না, তার মৃত্যুর পর কেউ তাকে বা তার পরিসরের জিনিসগুলোকে অতিরিক্ত মূল্যায়ন করুক।
আরও সম্ভবনা ছিল যে, তিনি নিজের শ্রীমন্ত বা ধনসম্পদের প্রতি কোনো আগ্রহ প্রকাশ করতে চাননি, কারণ তার কাছে মানসিক শান্তি বা শুদ্ধতা ছিল সবচেয়ে বড়ো। বালটি যে সোনার তৈরি, এটা জানালে মানুষের মনে অন্য রকমের ধারণা তৈরি হতে পারতো এবং নিশানাথবাবু হয়তো সেই বিষয়টি এড়িয়ে যেতে চেয়েছিলেন।
আরও দেখো—ষষ্ঠ শ্রেণির বাংলা গল্প-কবিতার সৃজনশীল প্রশ্ন উত্তর
শিক্ষার্থীরা, উপরে তোমাদের আনন্দপাঠ বই থেকে আলাউদ্দিনের চেরাগ গল্পের বর্ণনামূলক প্রশ্ন উত্তর নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। তোমাদের পরীক্ষা প্রস্তুতির জন্য ৩টি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন এখানে দেওয়া হয়েছে। এ প্রশ্নগুলো খুব ভালোভাবে অনুশীলন করার পরামর্শ থাকবে। পিডিএফ ফরমেটে উত্তরমালা সংগ্রহের জন্য ‘Answer Sheet’ অপশনে ক্লিক করো। এছাড়াও বাংলা বইয়ের গল্প-কবিতার সৃজনশীল, জ্ঞানমূলক, অনুধাবনমূলক এবং বহুনির্বাচনি সমাধানের জন্য উপরের লিংকটি অনুসরণ করো।
Discussion about this post