মাথাভর্তি উকুন এক মহাযন্ত্রণার নাম। অনেকেই আছে যারা মাথায় উকুনের সমস্যায় অনেকদিন যাবত ভুগছেন। কিন্তু সঠিক পদ্ধতিতে উকুন দূর করার উপায় খুঁজে পাচ্ছেন না। হয়তো অনেক চেষ্টা করেছেন, ডাক্তারও দেখিয়েছেন। তবে কোনো ভাবেই কোন কাজ হচ্ছে না।
এমনটি যদি আপনার সঙ্গেও হয়ে থাকে তাহলে কোর্সটিকায় আমাদের আজকের এই আর্টিকেলটি আপনার জন্য। আজ আমরা এখানে সর্ম্পূ প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে উকুন দূর করার উপায় নিয়ে আলোচনা করব। পাশাপাশি এই মহাযন্ত্রণা থেকে বাঁচতে এমন কিছু কৌশল শেয়ার করব, যা আপনি আগে থেকে জানতেন না।
উকুন সম্পর্কে কিছু তথ্য
উকুন হল এক ধরনের পরজীবী পোকা। মাথায় উকুনে আক্রমণ হওয়াকে ইংরেজিতে পেডিকুলোসিস (Pediculosis) বলা হয়ে থাকে । থির্যাপটেরা বর্গভুক্ত রক্তচোষা উকুনের আক্রমণকে পেডিকুলোসিস বলা হয়। মানুষসহ অন্যান্য যেকোন রক্তবিশিষ্ট পশু-পাখি উকুনে আক্রান্ত হতে পারে।
মাথায় যখন উকুন আসলে ৭ থেকে ১০ দিনের ভিতরে ডিম পারা শুরু করে দেয়। আর পরবর্তী ১০ দিনের মধ্যেই উকুনগুলো বড় হয়ে যায়। আর এভাবেই ডিম থেকে সৃষ্ট উকুন খুব দ্রুতই সময়ের মধ্যেই সম্পূর্ণ মাথায় ছড়িয়ে পড়ে।
উকুনের অন্যতম প্রধান একটি সমস্যা হচ্ছে এটি যদি কারো মাথায় একবার প্রবেশ করে তাহলে বাড়ির অন্য সকলের মাথায় এই পোকা চলে যায়। অর্থাৎ এক জনের মাথা থেকে অন্য জনের মাথায় চলে যেতে থাকে। আর একবার যদি মাথায় বাসা তৈরি করলে খুব সহজে কিন্তু যেতে চায় না। তাই উকুন মাথায় তৈরির আগেই সচেতন হওয়া চাই।
উকুন কেন হয়?
নানা ধরনের অপরিস্কার-অপরিচ্ছন্নতা এবং উকুন আছে এমন কারো সংস্পর্শে আসলে উকুনের সংক্রমণ হতে পারে। উকুন হওয়ার বেশকিছু কারণ রয়েছে। যেমন-
- মাথা অপরিষ্কার থাকলে উকুন হতে পারে।
- চুল না শুকিয়ে ভেজা অবস্থায় বেঁধে রাখলে।
- নিয়মিত চুলের যত্ন না নিলে এবং না আঁচড়ালে।
- মাথায় খুসকি প্রচণ্ড বেড়ে গেলে।
- যাদের মাথায় উকুন আছে নিয়মিত তাদের সংস্পর্শে থাকলে।
- অন্যের চিরুনি ও তোয়ালে ব্যবহার করলে।
উকুন দূর করার উপায়
উপমাহাদেশে মাথার উকুন দূর করতে সাধারণত উকুন নাশক বিভিন্ন শ্যাম্পু ব্যবহার করতে দেখা যায়। তবে শ্যাম্পুগুলোর বেশকিছু পাশ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে। এগুলো মাথার স্কিন ক্ষতিগ্রস্থ করতে পারে। আবার চুলগুলোও অতি দ্রুত ঝড়িয়ে ফেলতে পারে। তাই কোন কৃত্রিম ঔষধ ব্যবহার না করে প্রাকৃতিক প্রতিষেধক ব্যবহার করা উচিত।
নিচে আমরা উকুন দূর করার বেশকিছু প্রাকৃতিক উপায় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। এখানে মাথার উকুন তাড়ানোর জন্য যেসকল উপকরণের কথা বলা হয়েছে, তা আপনি খুব সহজে এবং হাতের নাগালেই পেয়ে যাবেন। পাশাপাশি উপকরণগুলো সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক হওয়ায় পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ারও কোন ভয় নেই।
১. নারকেল তেল ব্যবহার করুন
প্রাচীন কাল থেকেই নারকেল তেল আমাদের ত্বক এবং চুলের জন্য অনেক উপকারী একটি উপাদান হিসেবে কাজ করে আসছে। এর প্রাকৃতিক গুণাগুণ প্রমাণিত। ২০১০ সালে ব্রাজিলে হওয়া একটি গবেষণায় দেখা গেছে, নারকেল তেল প্রাকৃতিকভাবে উকুন দূর করার জন্য বেশ কার্যকরী ভূমিকা পালন করে থাকে।
নারকেল তেলের সাথে অল্প পরিমাণে Tea tree oil অর্থাৎ লবঙ্গের তেল মিশিয়ে ব্যবহার করতে পারেন। একটি গবেষণায় প্রমাণিতম এই মিশ্রণটি ব্যবহার করার চার ঘণ্টার ভিতরেই মাথার প্রায় ৮০ শতাংশ উকুন মরে যায়।
২. নিম তেল ব্যবহার করুন
নিম মাথার চুলকানি কমাতে সাহায্য করার সাথে সাথে স্কাল্প ময়েশ্চারাইজ করে থাকে। উকুন দূর করার উপায় হিসেবে অনেকেই নিম তেলের ওপর আস্থা রাখেন। উকুনের থেকে সহজে মুক্তি পাওয়ার জন্য এটা কার্যকরী একটি পদ্ধতি।
গোসলের সময় শ্যাম্পুতে কয়েক ফোঁটা নিমের তেল মিশিয়ে নিন। অর্থাৎ হাতের তালুতে শ্যাম্পু এবং নিম তেলের কয়েক ফোঁটা দিয়ে একটি মিশ্রণ তৈরি করুন। এতে করে উকুনগুলো দ্রুত চলে যাবে। এমনকি আপনার মাথায় উকুনের ডিম থাকলে তা থেকেও পরিত্রাণ পাবেন।
৩. লেবুর রস ব্যবহার
আমরা সকলেই জানি লেবু প্রাকৃতিক জীবাণুনাশক হিসেবে কাজ করে। আর তাই উকুন দূর করার জন্য লেবুর রস অনেক কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। গোসলের অন্তত এক ঘণ্টা পূর্বে পর্যাপ্ত লেবুর রস চুলে লাগিয়ে নিন। এরপর এক ঘন্টা রস লাগানো অবস্থায় থাকুন। এক ঘণ্টা পরে গোসল করে নিন। পরীক্ষিত এ পদ্ধতিটি সপ্তাহে অন্তত দুইবার ব্যবহার করতে পারলে ভালো ফলাফল পাওয়া যাবে।
৪. রসুনের পেস্ট
আপনি কি জানতেন যে, রসুন দিয়েও উকুন দূর করা সম্ভব? হ্যাঁ, আসলেও ঠিক তাই। আপনার মাথায় যদি উকুন বাসা বাধে, তাহলে আপনি রসুনের পেস্ট ব্যবহার করতে পারেন। প্রথমে ১০ কোয়া রসুন নিন। ভালোভাবে করে খোসা ছাড়িয়ে নেবেন এগুলো বেটে নিন। এর সাথে ২ চা চামচ লেবুর রস মিশিয়ে পেস্টের মতো তৈরি করে করুন।
তৈরি করা রসুনের পেস্টটি মাথার ত্বকে ভালো করে ঘষে লাগিয়ে নিন। খেয়াল রাখুন, চুলের গোড়ার কোন অংশ যাতে করে বাদ না পড়ে যায়।আর এইভাবে ৩০ মিনিট পর্যন্ত পেস্টটি চুলে লাগিয়ে রেখে হালকা গরম পানিতে চুল ধুয়ে নিন। সপ্তাহে তিনদিন পর্যন্ত এই পদ্ধতিটি অনুসরণ করা গেলে উকুনের সমস্যা থেকে খুব সহজেই মুক্তি পেয়ে যাবেন।
৫. চিকন দাঁতের চিরুনি ব্যবহার করুন
বাজারে মাথার চুল আচড়ানোর সাধারণ চিরুনির পাশাপাশি চিকন দাঁতের চিরুনিও পাওয়া যায়। এগুলোর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এধরনের চিরুনির দাঁতগুলো খুবই চিকন এবং ঘন হয়। যার ফলে এ চিরুনিগুলো খুব সহজেই চুলের গভীর থেকে উকুন খুঁজে আনতে পারে।
ইতিহাসে জানা যায়, প্রাচীন মিশরীয়রা উকুন দূর করার জন্য কাঠের তৈরি খুবই চিকন দাঁতের চিরুনি ব্যবহার করতেন। চুলে শ্যাম্পু করে নেওয়ার পরে এ ধরনের চিরুনি দিয়ে ভালোভাবে চুল ব্রাশ করুন। আপনি নিজের চোখেই দেখতে পাবেন উকুনগুলো কীভাবে চিরুনির সাথে বের হয়ে আসছে।
৬. ভিনেগার
উকুনমুক্ত চুল পেতে ভিনেগার দারুণ সহায়তা করে। ভিনেগারে রয়েছে প্রচুর আসিটিক আ্যাসিড যা চুলে হওয়া উকুনকে মারতে সাহায্য করে। গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, ভিনেগার কেবল উকুন দূরই করে না, ডিমগুলোও মেরে ফেলে।
কীভাবে ব্যবহার করবেন? ভিনেগার আর সাধারণ তেলের একটি মিশ্রণ তৈরি করে ঘুমোনোর আগে তা চুলে লাগিয়ে রাখুন। সকালে ঘুম থেকে উঠে শ্যাম্পু দিয়ে গোসল করে নিন। সপ্তাহে ২-৩ বার এই মিশ্রণটি লাগালে কয়েক দিনের মধ্যেই উকুন দূর হয়ে যাবে।
লবণ এবং ভিনেগারের মিশ্রণও উকুন তাড়াতে বেশ কার্যকরী। লবণ উকুনগুলোকে দুর্বল করে ফেলে এবং ভিনেগার নতুন জন্মানো উকুন এবং নিটগুলোকে (ডিম) ধ্বংস করে। যদিও এই পদ্ধতিতে বড় উকুনগুলো মরে না, কিন্তু তারা আর চুলের সঙ্গে লেগে থাকতে পারে না।
৭. হেয়ার ড্রায়ার ব্যবহার করুন
হেয়ার ড্রায়ারের গরম বাতাসের মাধ্যমে উকুনের ডিম মেরে ফেলা সম্ভব। অন্যান্য পদ্ধতির সঙ্গে হেয়ার ড্রায়ারের গরম বাতাস অতিরিক্ত ব্যবস্থা হিসেবে রাখলে উকুন থেকে চিরতরে রেহাই পাওয়া সম্ভব। এটা জীবন্ত উকুন হয়তো মারবে না কিন্তু উকুনের ডিমগুলো ধ্বংস করার ক্ষেত্রে কার্যকরী ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে। সুতরাং হেয়ার ড্রায়ার এক্ষেত্রে অস্ত্রের মতো ব্যবহৃত হতে পারে যা দিয়ে উকুনের উপদ্রব দমন করা সম্ভব।
উকুন দূর করার আরো কিছু টিপস
- পুরো চুল ও মাথার ত্বকে মেয়নিজ লাগািয়ে মাথা ভালো করে মাসাজ করুন। ২ ঘণ্টা পর চিকন দাঁতের চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়ে ফেলুন।
- শিশুদের চুলে উকুন হলে অ্যান্টি-লাইস শ্যাম্পু ব্যবহার করতে পারেন। শ্যাম্পুর সাথে ১০-১৫ ফোঁটা টি-ট্রি অয়েল মিশিয়ে নিলে ভালো ফল পাওয়া যাবে।
- ভিনেগার দিয়ে চুল ধুতে পারেন। এতে ২-৩ দিনে চুল থেকে উকুনের ডিমগুলো ঝরে পড়বে।
- লেবুর রস ও মাখন ভালো করে মিশিয়ে মাথায় লাগান। ১০ মিনিট অপেক্ষা করে চুল শ্যাম্পু করে ধুয়ে ফেলুন। একদিন পর পর এই কাজ করুন।
- অ্যাপেল সিডার ভিনেগার, অলিভ অয়েল ও রসুন বাটা মিশিয়ে মাথায় লাগিয়ে ২ ঘণ্টা। তারপর চুল ধুয়ে, শুকিয়ে সাদা ভিনেগার চুলে স্প্রে করুন । এরপর চিকন দাঁতের চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়ান।
উকুনের সংক্রমণ এড়াতে করণীয়
আর্টিকেলের শুরুতেই বলা হয়েছে, নানাবিধ অপরিস্কার-অপরিচ্ছন্নতা এবং উকুন আছে এমন কারো সংস্পর্শে আসলে উকুনের সংক্রমণ হতে পারে। তাই উকুনের সংক্রমণ এড়াতে নিয়মিত মাথা পরিস্কার রাখুন এবং চুল আঁচড়ান। নারীদের ক্ষেত্রে কখনোই গোসলের পরে চুল না শুকিয়ে ভেজা অবস্থায় বেঁধে রাখা উচিত নয়। ভেজা চুলে উকুন খুব দ্রুত বংশবিস্তার করে।
মাথায় খুসকি বেড়ে গেলে খুসকি দূর করার উপায়গুলো খুঁজুন। কেননা খুঁশকি দূর করতে না পারলে চুলে উকুনের সংক্রমণ বৃদ্ধির সম্ভাবনা থাকে। পাশাপাশি মাথায় উকুন আছে এমন ব্যক্তির সংস্পর্শে থাকা বাধ্যতামূলক হলে তাদের উকুন দূর করার কৌশলগুলো জানিয়ে দিন। নিজের ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য আলাদা চিরুনি ও তোয়ালে ব্যবহার করুন। যেকোন অবস্থায় অন্যের ব্যবহৃত চিরুনি ও তোয়ালে ব্যবহার থেকে বিরত থাকুন।
প্রায় জিজ্ঞাসিত কিছু প্রশ্নের উত্তর
১. উকুন ও নিটের মধ্যে পার্থক্য কী?
উত্তর: উকুন এক ধরনের পরজীবী। অপরদিকে উকুনের ডিমকে নিট বলা হয়।
২. উকুন ও নিট কি আমার মাথায় অন্যের চুল থেকে আসতে পারে?
উত্তর: অবশ্যই। উকুন খুব সহজেই এক মাথা থেকে আরেক মাথায় চলে যায়।
৩. উকুন মারার জন্য বাজারে যে সব ঔষধ পাওয়া যায় সেগুলো কী ক্ষতিকর?
উত্তর: হ্যাঁ, ক্ষতিকর। এ ধরনের প্রসাধনি বা ঔষধে ক্ষতিকর রাসায়নিক থাকে। এসব ঔষধের অতিমাত্রায় ব্যবহার উকুন দূর করলেও চুল একেবারে নষ্ট হয়ে যায়।
৪. লবণ জল কি উকুন মারতে সক্ষম?
উত্তর: শুধু লবণের এই ক্ষমতা নেই। তবে লবণের সাথে কিছুটা ভিনেগার মেশালে সেটি উকুন ও উকুনের ডিম মারতে পারে।
৫. কোন ধরনের চুলে উকুনের উৎপাত বেশি হয়?
উত্তর: কমবেশি সকলের চুলেই উকুনের উৎপাত হতে পারে। তবে মাথার তালু যদি অপরিচ্ছন্ন ও ময়লা থাকে, তবে উকুন সেখানে খুব সহজেই বাসা বাঁধতে সক্ষম হয়।
শেষ কথা
বিরক্তির আরেক নাম উকুন। অতিরিক্ত উকুন মানসিক বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। আর তাই সংক্রমণ দেখা মাত্রই দ্রুত উকুন দূর করার উপায় অনুসরণ করতে হবে। আজকের এ দীর্ঘ আলোচনায় আমরা আপনাকে এমনই কিছু গুরুত্বপূর্ণ ও কার্যকরী পদ্ধতি সম্পর্কে জানালাম। যা প্রাচীনকাল থেকে বিশ্বব্যপী উকুন তাড়ানোর জন্য বহুল ব্যবহৃত।
তাই আর দেরী না করে আজই উপরোক্ত প্রাকৃতিক উপায়গুলো পরীক্ষা করে দেখুন। আর হ্যাঁ, পূর্বের মতই পরামর্শ থাকবে, কোনরূপ কেমিকাল ব্যবহার না করে সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত প্রাকৃতিক উপকরণগুলোর ওপর আস্থা রাখুন। যা আপনাকে দীর্ঘমেয়াদী সুফল দান করবে।
Discussion about this post