কত কাল ধরে আনিসুজ্জামান : বাংলাদেশের ইতিহাস আড়াই হাজার বছর বা তারও বেশি সময়ের পুরোনো। ইতিহাসে থাকে সব রকমের মানুষের জীবনযাত্রার পরিচয়। এককালে বাংলাদেশে রাজার শাসন ছিল না, লোকজন নিজেরাই মিলে-মিশে যুক্তি-পরামর্শ করে দেশ চালাত।
তেইশ-চব্বিশ-শ বছর আগে রাজ-রাজড়ার শাসন শুরু হলো প্রাচীনকালে পুরুষেরা পরত ধুতি-চাদর, আর মেয়েরা শাড়ি-ওড়না। সাধারণ লোকের জুতা পরার সামর্থ্য ছিল না, তারা পরত কাঠের খড়ম। পুরোনো দিনেও এ দেশের মানুষের সাজগোজের দিকে নজর ছিল।
সোনার অলংকার পরার সুযোগ পেত শুধু ধনীরা। মাছ-ভাত-তরিতরকারি-দুধ-ঘি ইত্যাদি ছিল সেকালের বাঙালির প্রিয় খাদ্য। ইলিশ মাছ ছিল বেশি প্রিয়। কুস্তি ছিল সেকালের পুরুষদের অত্যন্ত প্রিয় খেলা, নারীদের ছিল সাঁতার। ধনীরা দেখত ঘোড়া ও হাতির খেলা, গরিবরা মজা পেত ভেড়ার লড়াই, মোরগ-মুরগির লড়াই দেখে।
কত কাল ধরে আনিসুজ্জামান
জলপথই ছিল যাতায়াতের প্রধান পথ, তবে স্থলপথও ছিল। বেশির ভাগ লোকই থাকত কাঁচাবাড়িতে। লেখক- কবিদের কেউ কেউ লিখতেন আনন্দ ও সমৃদ্ধির কথা, কারো কারো লেখায় থাকত বেদনা ও দারিদ্র্যের ছবি। সেকালে রাজ-রাজড়া ছিল, এখন নেই। কিন্তু ধনী-দরিদ্র এখনও আছে। সেকালেও সাধারণ মানুষ স্বপ্ন দেখতো সরু চালের সাদা গরম ভাতের। একালেও তারা তাই দেখছে।
মননশীল প্রাবন্ধিক ও গবেষক আনিসুজ্জামানের জন্ম ১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দে, কলকাতায়। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমিরিটাস অধ্যাপক ছিলেন। বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে তাঁর বেশ কিছু গবেষণাগ্রন্থ রয়েছে। উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলো হলো: ‘মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য’, ‘মুসলিম বাংলার সাময়িকপত্র’, ‘মুনীর চৌধুরী’, ‘স্বরূপের সন্ধানে’, ‘পুরনো বাংলা গদ্য’। এ ছাড়া তিনি বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত ‘বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস’ গ্রন্থের প্রধান সম্পাদক।
সাহিত্য-সাধনা ও গবেষণার স্বীকৃতি হিসেবে তিনি বিভিন্ন পুরস্কার ও পদকে ভূষিত হন। এগুলো হচ্ছে: দাউদ পুরস্কার, বাংলা একাডেমি পুরস্কার, একুশে পদক, পদ্মভূষণ (ভারত) ইত্যাদি। তিনি ২০২০ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেণ।
প্রবন্ধের শুরু এখানে
বাংলাদেশের ইতিহাস প্রায় আড়াই হাজার বছরের ইতিহাস। হয়তো আরও বেশি সময়ের। এ ইতিহাসের সবটা আজও ভালো করে জানা নেই আমাদের। আলো-আঁধারের খেলায় অনেক পুরানো কথা ঢাকা পড়েছে।
ইতিহাস বলতে শুধু রাজ-রাজড়াদের কথাই বোঝায় না। বোঝায় সব মানুষের কথা। এককালে এদেশে রাজ-রাজড়া ছিল না, তখন মানুষের দাম ছিল বেশি। লোকজন নিজেরাই যুক্তি পরামর্শ করে কাজ করত, চাষ করত, ঘর বাঁধত, দেশ চালাত।
তারপর তেইশ-চব্বিশশ বছর আগে- রাজা এলেন এদেশে। সেই সঙ্গে মন্ত্রী এলেন, সামন্ত-মহাসামন্তের দল এলেন। কত লোক-লস্কর বহাল করা হলো, কত ব্যবস্থা, কত নিয়মকানুন দেখা দিল।
এক কথায় তখন কারো গর্দান যেত, কেউ বড় লোক হয়ে যেত কারও খুশির বদৌলতে। তখন থেকে ইতিহাসে বড় বড় অক্ষরে রাজাদের নাম লেখা হয়ে গেল, আর প্রজারা রইল পেছনে পড়ে।
তবু এদের কথা কিছু কিছু জানা যায়, পরিচয় পাওয়া যায় এদের জীবনযাত্রার। হাজার বছর আগে সব পুরুষই পরত ধুতি, সব মেয়েই শাড়ি। শুধু সচ্ছল অবস্থা যাদের, তাদের বাড়ির ছেলেরা ধুতির সাথে চাদর পরত, মেয়েরা শাড়ির সাথে ওড়না ব্যবহার করত।
এখনকার মতো তখনো মেয়েরা আঁচল টেনে ঘোমটা দিত, শুধু ওড়নাওয়ালিরা ঘোমটা দিত ওড়না টেনে। তবে ধুতি আর শাড়ি দুই-ই হতো বহরে ছোট। তাতে নানা রকম নকশাও কাটা হতো। কত কাল ধরে আনিসুজ্জামান মখমলের কাপড় পরত শুধু মেয়েরা। নানারকম সুক্ষ্ম পাটের ও সুতোর কাপড়ের চল ছিল। জুতো পরতে পেত না সাধারণ লোকে-শুধু যোদ্ধা বা পাহারাদাররা জুতো ব্যবহার করত। সাধারণে পরত কাঠের খড়ম। ছাতা-লাঠির ব্যবহার ছিল।
সাজসজ্জার দিকে বেশ ঝোঁক ছিল প্রাচীন বাঙালির। চুলের বাহার ছিল দেখবার মতো। বাবরি রাখত ছেলেরা। না হয় মাথার ওপরে চুড়ো করে বাঁধত চুল। এখন মেয়েরা যেমন ফিতে বাঁধে চুলে, তখন শৌখিন পুরুষেরাও অনেকটা তেমনি করে কোঁকড়া চুল কপালের ওপর বেঁধে রাখত।
মেয়েরা নিচু করে ‘খোঁপা’ বাঁধত-নয়তো উঁচু করে বাঁধত ‘ঘোড়াচুড়’। কপালে টিপ দিত, পায়ে আলতা, চোখে কাজল আর খোঁপায় ফুল। নানারকম প্রসাধনীও ব্যবহার করত তারা।
মেয়েরা তো বটেই, ছেলেরাও সে বুগে অলংকার ব্যবহার করত। সোনার অলংকার পরতে পেত শুধু বড়লোকেরা। তাদের বাড়ির ছেলেরাও সুবর্ণকুণ্ডল পরত, মেয়েরা কানে দিত সোনার ‘তারঙ্গ’। হাতে, বাহুতে, গলায়, মাথায় সর্বত্রই সোনা-মণি-মুক্তো শোভা পেত তাদের মেয়েদের। সাধারণ পরিবারের মেয়েরা হাতে পরত শাঁখা, কানে কচি কলাপাতার মাকড়ি, গলায় ফুলের মালা।
ভাত বাঙালির বহুকালের প্রিয় খাদ্য। সরু সাদা চালের গরম ভাতের কদর সব চাইতে বেশি ছিল বলে মনে হয়। পুরোনো সাহিত্যে ভালো খাবারের নমুনা হিসেবে যে তালিকা দেওয়া হয়েছে, তা এই কলার পাতায় গরম ভাত, গাওয়া ঘি, নালিতা শাক, মৌরলা মাছ আর খানিকটা দুধ।
লাউ, বেগুন ইত্যাদি তরিতরকারি প্রচুর খেত সেকালের বাঙালিরা, কিন্তু ডাল তখনো বোধহয় খেতে শুরু করে নি। মাছ তো প্রিয় বস্তুই ছিল- বিশেষ করে ইলিশ মাছ। শুটকির চল সেকালেও ছিল-বিশেষ করে দক্ষিণাঞ্চলে। ছাগমাংস সবাই খেত- হরিণের মাংস বিয়ে বাড়িতে বা এরকম উৎসবেই সাধারণত দেখা যেত।
পাখির মাংসও তাই। ক্ষীর, দই, পায়েস, ছানা-এসব ছিল বাঙালির নিত্যপ্রিয়। আম-কাঁঠাল, তাল-নারকেল ছিল প্রিয় ফল। আর খুব চল ছিল খাজা, মোয়া, নাড়ু, পিঠেপুলি, বাতাসা, কদমা এসবের। মশলা দেওয়া পান খেতেও সকলে ভালোবাসত।
সাধারণ লোকে মাটির পাত্রেই রান্নাবান্না করত। ‘জালা’, ‘হাঁড়ি’, ‘তেলানি’- সচরাচর এসব পাত্রের ব্যবহারই করা হতো। সেকালের পুরুষেরা ছিল শিকারপ্রিয়। কুস্তি খেলারও চল ছিল বেশ। মেয়েরা সাঁতার দিতে ও বাগান করতে ভালোবাসত।
মেয়েরা খেলত কড়ির খেলা-ছেলেরা দাবা আর পাশা। বড়লোকরা ঘোড়া আর হাতির খেলা দেখত। যাদের সে ক্ষমতা ছিল না, তারা ভেড়ার লড়াই আর মোরগ-মুরগির লড়াই বাঁধিয়ে দিত।
নাচগানের বেশ প্রসার ছিল। বীণা, বাঁশি, কাড়া, ছোটডমরু, ঢাক-এসব বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার ছিল। যাতায়াতের প্রধান উপায় ছিল নৌকা। হাতির পিঠে ও ঘোড়া-গাড়িতে চড়ত শুধু অবস্থাপন্ন লোকেরা। গরুর গাড়ি সাধারণ লোকে ব্যবহার করত-তবে সব সময় নয়-বিশেষ উপলক্ষে। মেয়েরা ‘ভুলি’তে চড়ত। পালকির ব্যবহারও ছিল। বড় লোকদের পালকি হতো খুব সাজানো-গোছানো, রাজবাড়িতে হাতির দাঁতের পালকিও থাকত।
বেশির ভাগ লোকই থাকতো কাঠ-খড়-মাটি-বাঁশের বাড়িতে। বড় লোকেরাই শুধু ইট-কাঠের বাড়ি করত। ওপরের বর্ণনা দিতে গিয়ে বারবার বলতে হয়েছে সকলে এক রকম ছিল না। কেননা, সেই পুরোনো কাল আর নেই, যখন সবাই মিলে মিশে কাজ করত। রাজা এসে গেছেন সমাজে।
তাই কেউ প্রভু, কেউ ভৃত্য। কেউ প্রভুর প্রভু, কেউ দাসের দাস। দুজন প্রাচীন সংস্কৃত কবির রচনায় তাই এমন দুটি ছবি পাওয়া যায়-সে দুটো ছবি যে একই দেশের, সে কথা মনে হয় না। একজন দিয়েছেন মেয়েদের বর্ণনা কপালে কাজলের টিপ, হাতে চাঁদের কিরণের মতো সাদা পদ্মবৃন্তের বালা ও তাগা, কানে কচি রিঠা ফলের দুল, স্নানস্নিগ্ধ কেশে তিলপল্লব।
আরেকজন এঁকেছেন সংসারের ছবি, নিরানন্দে তার দেহ শীর্ণ, পরনে ছেঁড়া কাপড়। ক্ষুধায় চোখ আর পেট বসে গেছে শিশুদের, যেন এক মণ চালে তার একশ দিন চলে যায়। রাজাদের দল এখন আর নেই। মৌর্য-গুপ্ত, পাল-সেন, পাঠান-মুঘল, কোম্পানি-রানি এদের কাল শেষ হয়েছে।
আজকের দুই কবিও হয়তো দুই প্রান্তে বসে এমনি করে কবিতা লিখছেন। একজন লিখছেন সমৃদ্ধির কথা, বিলাসের কথা, আনন্দের কথা। আরেকজন ছবি আঁকছেন নিদারুণ অভাবের, জ্বালাময় দারিদ্র্যের, অপরিসীম বেদনার। সরু চালের সাদা গরম ভাতে গাওয়া ঘি-কত কাল ধরে কত মানুষ শুধু তার স্বপ্নই দেখে আসছে।
কত কাল ধরে প্রবন্ধের সৃজনশীল প্রশ্ন
১. শহরের মেয়ে দীপা তার নানাকে নিয়ে নানা বাড়ির গ্রাম দেখতে বের হয়। তার নানা প্রথমে তাকে একটা অবস্থাপন্ন পরিবারে নিয়ে যান। এ পরিবারে তার বয়সী মেয়েরা সালোয়ার-কামিজ পরে, ঠোঁটে লিপিস্টিক দেয়, হাতে চুড়ি ও কানে স্বর্ণের দুল পরে।
গৃহিণীরা তাঁতের শাড়ি পরে এবং শাড়ির আঁচল টেনে ঘোমটা দেয়। তাঁদের হাতে ও গলায় স্বর্ণালংকার শোভা পাচ্ছে। এ বাড়ি পেরিয়ে দীপা এক দিনমজুরের খড়ের তৈরি ঝুপড়ি ঘরে ঢুকে পড়ে। দিনমজুরের স্ত্রীর পরনে মলিন শাড়ি, সন্তানদের পরনে ছেঁড়া হাফপ্যান্ট এবং শরীরের রুগ্ণ দশা দেখে দীপার খুব মনঃকষ্ট হয়। সে ভাবে, শত শত বছর চলে যায়, কিন্তু এদেশের দরিদ্র মানুষের জীবনের অভাবগুলো আর চলে যায় না।
ক. বাংলাদেশের ইতিহাস কত বছরের পুরোনো?
খ. ইতিহাস বলতে বোঝায় সব মানুষের কথা-ব্যাখ্যা কর।
গ. দীপার দেখা গ্রামের লোকজনের পোশাক-পরিচ্ছদের সাথে হাজার বছর আগের পূর্বপুরুষদের পোশাকের যে মিল পাওয়া যায় তা বর্ণনা কর।
ঘ. ‘শত শত বছর চলে যায়, কিন্তু এদেশের মানুষের জীবনের অভাবগুলো চলে যায় না।’- উদ্দীপক এবং ‘কত কাল ধরে’ প্রবন্ধের আলোকে ব্যাখ্যা কর।
◉ আরও দেখুন: ষষ্ঠ শ্রেণির সকল গল্প-কবিতার CQ-MCQ সমাধান
শিক্ষার্থীরা, উপরে ষষ্ঠ শ্রেণির বাংলা বই থেকে কত কাল ধরে আনিসুজ্জামান প্রবন্ধটি আলোচনা করা হয়েছে। এই বইয়ের যে সৃজনশীল প্রশ্নগুলো রয়েছে, তার উত্তরও তোমরা কোর্সটিকায় পেয়ে যাবে। সৃজনশীল প্রশ্নের সমাধানের জন্য উপরের ‘সৃজনশীল সমাধান’ অপশনে ক্লিক করো।
Discussion about this post