আল্লাহ আমাদের ইবাদত পালনে প্রয়োজনে নিয়মের শিথিলতা দান করেছেন। কসর নামাজ হচ্ছে তারই মধ্যে একটি। কোর্সটিকার ধর্মকথা বিভাগে আজকের এ আলোচনায় আমরা কসর নামাজ পড়ার নিয়ম এবং এ সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ অন্যান্য তথ্যসমূহ জানবো। পাশপাশি কসর নামাজের ফজিলত এবং এটি কীভাবে আদায় করতে হয়, সে সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব।
কসর নামাজ কি?
মুসাফিরের নামাজকে ইসলামী পরিভাষায় কসর নামাজ বলা হয়। কসর শব্দের অর্থ সংক্ষিপ্ত করা। আমরা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন প্রয়োজনে সফর বা ভ্রমণে বের হই। ফলে আমাদের পক্ষে অনেক সময় পূর্ণাঙ্গ নামাজ পড়া সম্ভব নাও হতে পারে। এমতাবস্থায় মূল নামাজকে সংক্ষিপ্ত করে আদায় করার বিধান রয়েছে। সাধারণত কসর নামাজ পদ্ধতিতে ৪ রাকাত বিশিষ্ট ফরজ নামাজ কমিয়ে ২ রাকাত পড়া হয়। মূল নামাজকে সংক্ষিপ্ত আকারে আদায় করার পদ্ধতিই হচ্ছে কসর নামাজ।
কসর নামাজ কেন পড়া হয়?
ইসলাম শুধুমাত্র একটি ধর্ম নয়, এটি মানবজাতির জন্য পূর্ণাঙ্গ একটি জীবনব্যবস্থা। আল্লাহ আমাদের জন্য ইসলাম অনেক সহজ করে দিয়েছেন। এরই ধারাবাহিকতায় কোন ব্যক্তি যদি সফর বা ভ্রমণে থাকা অবস্থায় পূর্ণাঙ্গ সালাত আদায় করতে না পারেন, তাহলে তিনি কসর নামাজ আদায় করে নিতে পারেন।
আমরা জানি, প্রতিদিন ৫ ওয়াক্ত নামাজের মধ্যে জোহর, আসর ও ইশা ৪ রাকাত বিশিষ্ট নামাজ। তবে কসর নামাজ পদ্ধতিতে ব্যক্তি ভ্রমণের ক্লান্তি দূর করতে ৪ রাকাত বিশিষ্ট এ ওয়াক্তগুলো ২ রাকাত করে আদায় করতে পারবেন।
কসর নামাজ কাদের জন্য?
কসর নামাজ মূলত মুসাফিরদের জন্য। কোনো ব্যক্তি তার অবস্থানস্থল থেকে ৪৮ মাইল তথা ৭৮ কিলোমিটার দূরে সফরের নিয়তে বের হয়ে তার এলাকা পেরিয়ে গেলেই ইসলামে দৃষ্টিতে তিনি মুসাফির হিসেবে গণ্য হবেন। এমন ব্যক্তিরা কসর নামাজ আদায় করতে পারবেন।
আকাশ পথে মুসাফিরের সফরের ক্ষেত্রেও দূরত্বের হিসাব স্থলভাগে সফরের দূরত্বের সমপরিমাণ হবে। অর্থাৎ স্থলভাগের ৭৮ কিলোমিটার পরিমাণ দূরত্বের সফর হলে ব্যক্তি আকাশপথে মুসাফির হবেন। অনুরূপ পার্বত্য এলাকায় সফরের ক্ষেত্রেও সমতলে চলার হিসেবেই হবে। অর্থাৎ পাহাড়ের উচু-নিচু ঢালুসহ দূরত্বের হিসাব হবে।
কসর নামাজ কত রাকাত?
আমরা আগেই উল্লেখ করেছি, কসর নামাজে ৪ রাকাত বিশিষ্ট ফরজ নামাজ কমিয়ে ২ রাকাত পড়া হয়। ৫ ওয়াক্ত নামাজের মধ্যে জোহর, আসর ও ইশা ৪ রাকাত বিশিষ্ট নামাজ। ফলে কসর নামাজ পদ্ধতিতে ব্যক্তি ভ্রমণের ক্লান্তি দূর করতে ৪ রাকাত বিশিষ্ট এ ওয়াক্তগুলো ২ রাকাত করে আদায় করতে পারবেন।
মুসাফিরের নামাজের নিয়ম
মুসাফির ৪ রাকাতবিশিষ্ট ফরজ নামাজ একাকী পড়লে বা তার মতো মুসাফির ইমামের পেছনে আদায় করলে, নামাজ কসর করা জরুরি। এক্ষেত্রে পূর্ণ নামাজ পড়া ঠিক নয়।
এ প্রসঙ্গে হাদিসে বলা হয়েছে, হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘আল্লাহ তোমাদের নবীর জবানে নামাজকে মুকিম অবস্থায় চার রাকাত ও সফর অবস্থায় দুই রাকাত ফরজ করেছেন। ’ (মুসলিম, হাদিস নং: ৬৮৭)
মুসাফির ব্যক্তি সফর অবস্থায় (নিজে একাকী কিংবা মুসাফির ইমামের পেছনে, স্থানীয় ইমামের পেছনে হলে অসুবিধা নেই। ) ইচ্ছাকৃত চার রাকাত নামাজ পূর্ণ করলে গুনাহ হবে। এ ক্ষেত্রে নামাজ পুনরায় পড়া ওয়াজিব। আর যদি ভুলক্রমে চার রাকাত পূর্ণ করে নেয়, তাহলে যদি সে প্রথম বৈঠক করে থাকে, তাহলে সেজদা সাহু করে নিলে ফরজ নামাজ আদায় হয়ে যাবে। আর যদি প্রথম বৈঠক না করে থাকে তাহলে ফরজ আদায় হবে না, আবারও পড়তে হবে। (বাদায়েউস সানায়ে ১/৯১)
কসর নামাজ পড়ার নিয়ম
৫ ওয়াক্ত নামাজের মধ্যে কেবল ৪ রাকাত বিশিষ্ট ফরজ নামাজ যেমন- জোহর, আসর ও এশার নামাজ ৪ রাকাতের পরিবর্তে ২ রাকাত করে পড়া হয়। কসর নামাজ পড়ার নিয়ম বিস্তারিতভাবে নিচে তুলে ধরা হল।
১. মুসাফির ইমামতি করলে মুক্তাদিদের আগেই বলে দেবে যে, সে মুসাফির এবং ২ রাকাত পড়ে সালাম ফিরাবে এবং মুকিম নামাজিরা দাঁড়িয়ে বাকি ২ রাকাত পড়ে নেবেন।
২. মুসাফির ব্যক্তি যদি মুকিম ইমামের পেছনে নামাজ পড়েন তাহলে ইমামের অনুসরণে তিনিও ৪ রাকাত পড়বেন।
৩. মুসাফির অবস্থায় যদি কোনো নামাজ কাজা হয়ে যায়, আর তা বাড়ি ফিরে পড়েন তাহলে কসরই পড়বেন এবং বাড়ি থাকা অবস্থায় কোনো কাজা নামাজ যদি সফরে আদায় করেন তবে তা পূর্ণ নামাজই পড়তে হবে।
৪. প্রত্যেক নামাজের নিয়ত করতে হবে, কোন ওয়াক্তের কসর পড়বেন।
৫. মুসাফির ব্যক্তির ব্যস্ততা থাকলে ফজরের সুন্নত ব্যতীত অন্যান্য সুন্নত নামাজ ছেড়ে দেবেন। তবে ব্যস্ততা না থাকলে সুন্নত পড়া উত্তম।
৬. ১৫ দিন বা তার বেশি থাকার নিয়ত হয়নি এবং আগেই চলে যাবে চলে যাবে করেও যাওয়া হচ্ছে না, এভাবে ১৫ দিন বা তার বেশি দিন থাকলেও কসর পড়বেন।
৭. দুই রাকাত, তিন রাকাত ফরজ এবং ওয়াজিব নামাজ যথাযথভাবে আদায় করতে হবে।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: কেউ অসৎ উদ্দেশ্যে মুসাফির সাজলে শরিয়তের দৃষ্টিতে তিনি মুসাফির হিসেবে গণ্য হবেন না এবং তার জন্য কসরের হুকুমও প্রযোজ্য হবে না।
কসর নামাজ কতদিন পড়তে হয়
অনেকেরই প্রশ্ন থাকে যে, কসর নামাজ কতদিন পড়তে হয়? কসর নামাজ সাধারণত ১৫ দিন বা এর চেয়ে কম সময়ের মধ্যে পড়া হয়। কোন ব্যক্তি যদি ১৫ দিন বা এর চেয়ে কম সময়ের নিয়তে ৪৮ মাইল তথা ৭৮ কিলোমিটার দূরে অবস্থান করেন, তাহলে তার জন্য কসর নামাজ প্রযোজ্য হবে।
কসর নামাজের ফজিলত
ইসলামে কসর নামাজের ফজিলত অনেক। আল্লাহ তার প্রিয় বান্দাদের সার্বিক কল্যাণের জন্য ধর্মীয় বিধানগুলো অনেক সহজ করে দিয়েছেন। আর কসর নামাজ তারই একটি নিয়ামত। নিচে কসর নামাজের ফজিলত উল্লেখ করা হল।
১. কসর নামাজের বিধানের মধ্যে মুসলিম উম্মাহর জন্য একটি বড় শিক্ষা রয়েছে। আর তা হলো কোনো অবস্থায়ই ফরজ ইবাদত অলসতার কারণে বা সমস্যা থাকার কারণে পুরোপুরি ছাড় দেয়ার সুযোগ নেই।
২. কসরের নামাজের ফজিলতের কথা বলে রাসূল সা: ইরশাদ করেন, ‘তোমরা সফরে নামাজকে কসর করো-এর মধ্যেই রয়েছে উত্তম প্রতিদান’ (বায়হাকি)।
৩. ইমামে আজম আবু হানিফা (রহ:) বলেন, ‘সফরে ৪ রাকাত নামাজকে ২ রাকাতই পড়তে হবে। কেননা আল্লাহ তায়ালা এ ২ রাকাতের বিনিময়ে ৪ রাকাতের প্রতিদান তো দেবেনই, সেই সাথে মুসাফির অবস্থায় নামাজ পড়ার সওয়াব অনেক বেশি। তাই সফরে কসর না পড়ে পূর্ণ নামাজ পড়া যাবে না।’
৪. মানুষ আল্লাহ তায়ালার প্রিয় সৃষ্টি। আল্লাহ তায়ালার নির্দেশের প্রতি অনুগত থাকাই তার একান্ত কর্তব্য। সেহেতু মানুষের তথা মুসলিম জাতির দায়িত্ব হলো যেখানে যে অবস্থাতেই সে থাকুক না কেন, আল্লাহ তায়ালার এবাদতে মশগুল থাকতে হবে।
►► আরো দেখুন: সঠিকভাবে তাহাজ্জুদ নামাজের নিয়ম
►► আরো দেখুন: আস্তাগফিরুল্লাহ দোয়া বাংলা উচ্চারণ
►► আরো দেখুন: জানাজার নামাজের নিয়ম PDF
শেষ কথা
প্রিয় পাঠক, আজকের এই নিবন্ধে আমরা কসর নামাজ পড়ার নিয়ম, কেন পড়া হয়, কাদের জন্য আদায় করা জরুরী ইত্যাদি তথ্য সম্পর্কে ধারণা লাভ করলাম। মহান আল্লাহ আমাদের সবাইকে সহী-শুদ্ধভাবে ইসলাম পালনের সক্ষমতা দান করুন। আমীন।
Discussion about this post