কুমড়ো ও পাখির কথা একটি শিক্ষামূলক গল্প, যেখানে প্রকৃতি, পরিবেশ ও জীবজগতের আন্তঃসম্পর্ক তুলে ধরা হয়েছে। গল্পে কুমড়ো, দোয়েল, বাতাস, সূর্য, শিশির ও টুনটুনি একে অপরের সঙ্গে কথা বলে, যা প্রকৃতির সৌন্দর্য ও ভারসাম্যের প্রতিচিত্র।
তবে মানুষের লোভের কারণে বনজঙ্গল ধ্বংস হয়ে আগুন লাগে, যা জীবজন্তুর জন্য বিপজ্জনক। গল্পটি আমাদের প্রকৃতির গুরুত্ব, পরিবেশ রক্ষা ও প্রাণিকূলের প্রতি দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন করে।
কুমড়ো ও পাখির কথা
[গ্রাম থেকে দূরে বনের ধারে, নির্জন জায়গায় ছিল এক মিষ্টিকুমড়োর লতা। লতায় ছিল একটি মাত্র মিষ্টিকুমড়ো। দেখতে বেশ গোলগাল। ছোট একটি কুল গাছে জড়ানো লতায় মিষ্টিকুমড়োটা ঝুলছিল। সকাল হলো। শিশির জমে আছে ঘাস ও লতাপাতায়।
[মিষ্টিকুমড়ো ও শিশির কথা বলছে।]
শিশির : ও কুমড়ো ভাই, ভালো আছ তো?
কুমড়ো : হ্যাঁ, ভালো। তুমি?
শিশির : আমিও ভালো।
কুমড়ো : তুমি খুব ভালো। রোজ তুমি আমার গা ধুইয়ে দাও। মনে কী যে ফুর্তি লাগে!
শিশির : বৃষ্টি না আসা পর্যন্ত ওটাই আমার কাজ। আমি গাছপালা ঘাস লতাপাতার গা ধুইয়ে দিই। ওরা কেমন সুন্দর হয়ে ওঠে। (এমন সময় চারদিকে আলো ফুটল, রোদ উঠল।)
রোদ: ও কুমড়ো, তুমি কেমন আছ?
কুমড়ো: তোমার দয়ায় ভালো আছি ভাই। ভোররাতে শিশির গা ধুয়ে দিয়ে গেছে। এখনও গায়ে তোমার আঁচ লাগছে। মনটা খুশিতে ভরে উঠেছে।
শিশির: আমি এখন যাই মিষ্টিকুমড়ো, কেমন? রোদ উঠেছে, এখন আমার যাওয়ার পালা। চলি তা হলে।
কুমড়ো: যাও ভাই, রাতে আবার দেখা হবে। (এমন সময় দোয়েল পাখি এল। পোকা খেতে খেতে দোয়েল বলে।)
দোয়েল: কী চমৎকার পোকা! তুমি খাবে কুমড়ো ভাই?
কুমড়ো: না ভাই, ওসব আমার খাদ্য নয়, বরং ওরা আমাদের দুশমন। ওদের জ্বালায় একটা ফুলও ফল হতে পারে না। পোকাগুলো সব খেয়ে সাবাড় করে।
দোয়েল: রোজ তোমার লতায় বসি, পাতায় বসি। তুমি রাগ কর না তো আবার?
কুমড়ো: রাগ করব কেন? তুমি আমাদের উপকারী বন্ধু। তুমি পোকা খাও বলেই তো আমরা বেঁচে থাকি। তোমার গান আমার খুব ভালো লাগে।
দোয়েল: তুমি বললে আর কী হবে। মানুষেরা যে আমাদের বাঁচতে দিচ্ছে না।
কুমড়ো: সে কী কথা! মানুষেরাই তো সবার বন্ধু। এই দেখ না, আমাকে একটা পাখি এখানে নিয়ে এসেছে বলে এখানে চারা থেকে গাছ হয়েছি। মানুষের বাড়িতে থাকলে আমাকে মাচা করে দিত।
দোয়েল: তা দিত ঠিক। কিন্তু মানুষ তো বনের গাছপালা কেটে সাফ করছে। মানুষ পাখি আর জীবজন্তুও খায়। ধরে ধরে খাঁচায় ভরে রাখে।
কুমড়ো: তাহলে তো খুব খারাপ বলতে হয়। তবে একদিন মানুষের নিশ্চয়ই সুবুদ্ধি হবে।
দোয়েল: কবে আর হবে! মানুষ মানুষকে মারার জন্য কত রকম অস্ত্র বানাচ্ছে, বোমা মারছে।
কুমড়ো: আজকাল শুনছি মানুষ গাছপালা বাড়াবার কথা বলছে। যুদ্ধের বিরুদ্ধে অনেকে কথা বলছে। মানুষেরা আমাদের মতো হলে ভালো হতো। দেখ, পাতায় পড়েছে রোদ। শেকড় এনে দিচ্ছে পানি। পাতার মধ্যে আমার রান্নাবান্না হচ্ছে। ওই খেয়ে আমি দিনে দিনে বাড়ছি।
দোয়েল: তোমাদের তো ভারি সুবিধে। আমাদের দেখ সারাদিন ডালে ডালে পোকা খুঁজতে হয়। যাই তাহলে ওই দিকটায় খুঁজে দেখি। পরে আবার আসব। (এই বলে দোয়েল ফুডুৎ করে উড়ে গেল।)
রোদ: তুমি তো খুব সুন্দর কথা বল। এতক্ষণে ধরে আমি তোমাদের কথা শুনছিলাম। আমার প্রশংসাও করছিলে বেশ।
কুমড়ো: উপকারীর উপকার স্বীকার করাই তো উচিত। তুমি হচ্ছ সবার উপকারী বন্ধু। তোমাকে ছাড়া দুনিয়া অচল।
রোদ: আমিও আসি ওই সূর্য থেকে। সূর্য না থাকলে আমাকে পেতে না। সূর্য না থাকলে পৃথিবী নামের এই গ্রহটাও থাকতো না। (এমন সময় বাতাস বইল। দোল খেল কুমড়ো। বাতাস কথা বলল।)
বাতাস: শুধু গ্রহ নয়, তাদের উপগ্রহরাও সূর্যের জন্য বেঁচে আছে।
কুমড়ো: চাঁদের আলো আমার খুব ভালো লাগে।
বাতাস: আমাকে তোমার কেমন লাগে? আমি যখন তোমাকে ছুঁয়ে যাই তখন-
কুমড়ো: তোমার জন্যই তো ফুল থেকে ফুলে পরাগ যায়। তাতে ফুল থেকে ফল হয়। ভোমরা আর মৌমাছিও এ কাজে সাহায্য করে। টুনটুনি পাখিও ফুল থেকে ফুলে পরাগ নিয়ে যায়। আমরা এভাবে একে অপরের সাহায্যে বড় হই, বেঁচে থাকি।
(এমন সময় বনের ফিঙে, টিয়ে ও বানরের চেঁচামেচি শুরু হয়ে গেল। বাতাসও কিছু না বলে সে দিকে ছুটল। কুমড়ো একা হয়ে গেল। হঠাৎ একটা টুনটুনি উড়ে এসে বলতে লাগল-)
টুনটুনি: মানুষের কথা আর বোলো না। গাছ মানুষকে ফুল, ফল, ছায়া দেয়। অথচ তারা গাছ কেটে উজাড় করে।
কুমড়ো: কী হয়েছে ভাই? গাছ কাটার কথা শুনে আমার খুব ভয় করছে।
টুনটুনি: বনের ভেতর কে যেন চাষ করার জন্য গাছপালা কেটে জমি করেছে। তারপর সেই ডালপালা পোড়ানোর জন্য আগুন দিয়েছে, আর সেই আগুন চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। সে এক ভীষণ কাণ্ড।
কুমড়ো: তারপর?
টুনটুনি: এখন বৈশাখ মাস। পাতা, ডালপালা সব শুকিয়ে। গেছে। কোথা থেকে হাওয়াও এসে জুটেছে। দাউ দাউ করে জ্বলছে সব কিছু।
কুমড়ো: এখন উপায়। আগুন এখানে আসবে না তো?
টুনটুনি: ওই দেখ- টিয়ে, ফিঙে, দাঁড়কাক, বানর, ভালুক সবাই মিলে ছোটাছুটি চেঁচামেচি করে বন তোলপাড় করে তুলেছে। চেঁচামেচিতে মানুষ ছুটে এসেছে। আগুন নেভাচ্ছে।
কুমড়ো: মানুষই আগুন দিয়েছে, আবার মানুষই ছুটে এসেছে আগুন নেভাতে? আমি বুঝি না মানুষ কেন এমন করে! তা হলে তো অনেক পশুপাখি পুড়ে মরেছে। অনেক জ্যান্ত গাছপালা পুড়ে গেছে। তোমার টোনা কোথায়?
টুনটুনি: আমি সেখানে একটুখানি উঁকি মারতে গিয়েছিলাম। টোনা বলল, এদিকে এসে সকলকে সতর্ক করে দিতে! টোনা দোয়েলের সেবা করছে। দোয়েলের গায়ে নাকি একটু আঁচ লেগেছে।
কুমড়ো: তোমরা ভাই খুব ভালো। একজনের বিপদে আরেকজনকে খবর দাও, খোঁজখবর নিতে পার। আর আমাদের গাছের সঙ্গে ঝুলে থেকে সব করতে হয়।
টুনটুনি: আমি যাই। কাঠবিড়ালি বন্ধুদের খবর নিয়ে আসি।
(এই বলে টুনটুনি ফুডুৎ করে উড়ে গেল। কুমড়ো আবার একা। এদিকে রোদের সঙ্গে, মাটির সঙ্গে, কুলগাছের সঙ্গে কথা বলতে বলতে কুমড়ো দিনে দিনে বাড়তে লাগল। বর্ষা এল, চলেও গেল। শরতে মিষ্টিকুমড়ো পেকে মাটিতে ঝরে পড়ল। তারপর একদিন দোয়েলকে দেখা গেল সেই কুল গাছে।)
দোয়েল: ও কুমড়ো ভাই, তুমি কোথায়? তোমাকে দেখছি না কেন? (মাটিতে কয়েকটি চারা উঠেছে। ওরা মিষ্টিকুমড়োর চারা। ওরা বলল)
চারা: তুমি কে ভাই? কাকে খুঁজছ?
দোয়েল: এখানে একটা মিষ্টিকুমড়ো গাছ ছিল। আর ছিল একটা সুন্দর কুমড়ো।
চারা: ও, আমাদের মায়ের কথা বলছ? আমরা তারই চারা। মাত্র কয়েক দিন হলো আমরা দাঁড়াতে শিখেছি। মা আমাদের সব কথা বলেছে। তোমার কথাও বলেছে।
দোয়েল
দোয়েল: কী বলেছে?
চারা: বলেছে তোমাকে মায়ের খবর দিতে। বনের পশুপাখিরা সেই আগুনের হাত থেকে বেঁচে গেছে কি না জানার খুব ইচ্ছা ছিল তার।
দোয়েল: সেই ভয়ানক আগুনের কথা আর মনে করতে চাই না। দুঃখ কষ্টের কথা যত ভুলে থাকা যায় ততই ভালো। তার চেয়ে আমি তোমাদের গান শোনাই। হাওয়ায় হাওয়ায় তোমরা নাচতে শুরু করো, আর আমি গানের সুর তুলি।
এই অধ্যায়ের অনুশীলনীমূলক কাজ
১. শব্দগুলোর অর্থ ও ব্যবহার জেনে নিই।
নির্জন – জনশূন্য, নিরিবিলি। — নির্জন নদীর তীরে রাখাল গান গাইছে।
দুশমন – শত্রু। — পোকা ফসলের দুশমন।
পরাগ – ফুলের রেণু। — মুখে ফুলের পরাগ মেখে লতার দোলনায় দুলব।
২. কথাগুলো বুঝে নিই।
রোদ উঠেছে তো, এখন আমার যাওয়ার পালা – রোদ উঠলে শিশির শুকিয়ে যায়। সে জন্য শিশির এ কথা বলছে।
তুমি আমাদের উপকারী বন্ধু অনেক পোকা – মাকড় গাছের ক্ষতি করে। দোয়েল পাখি সেসব খেয়ে ফেলে। তাই, কুমড়ো দোয়েলকে উপকারী বন্ধু বলছে।
পাতার মধ্যে আমার রান্নাবান্না হচ্ছে – গাছে রোদ পড়ে, শেকড় মাটি থেকে রস সংগ্রহ করে। এই রোদ
ও রস থেকে পাতা গাছের জন্য খাবার তৈরি করে। এজন্যই কুমড়ো বলেছে পাতায় তার রান্নাবান্না হচ্ছে।
ফুল থেকে ফুলে পরাগ যায় – প্রত্যেক ফুলে পরাগ থাকে। এক ফুল থেকে আরেক ফুলে পরাগ গেলে তবেই ফল হয়। বাতাস, মৌমাছি, ভোমরা ও পাখি ফুল থেকে ফুলে পরাগ নিয়ে যায়।
৩. নিচের প্রশ্নগুলোর উত্তর লিখি।
ক. দোয়েল পাখি কুমড়োর কী উপকার করে?
খ. মানুষের বিরুদ্ধে দোয়েল পাখি কী কী অভিযোগ করেছে?
গ. টুনটুনি কুমড়োকে কী খবর দিল?
ঘ. বনে আগুন লেগে কী ক্ষতি হল? আগুন নেভাতে কারা ছুটে এল?
ঙ. শরৎকালে কুলগাছে ফিরে এসে দোয়েল পাখি কী দেখল?
চ. ‘কুমড়ো ও পাখির কথা’ থেকে আমরা যা শিখেছি তা পাঁচটি বাক্যে লিখি?
৪. ডান দিক থেকে বিপরীত শব্দগুলো বেছে নিই।
লাভ | অসুবিধে |
দুশমন | কুবুদ্ধি |
উপকারী | নিন্দা |
সুবুদ্ধি | কুৎসিত |
সুবিধে | ক্ষতি |
প্রশংসা | বন্ধু |
সুন্দর | অপকারী |
৫. এক কথায় বলি।
যে উপকারীর উপকার স্বীকার করে —- কৃতজ্ঞ।
যে উপকারীর অপকার করে —- কৃতঘ্ন।
যে বেশি কথা বলে —- বাচাল।
যে হিংসা করে —- হিংসুক।
◉ আরও দেখুন: পঞ্চম শ্রেণির বাংলা বইয়ের সকল গল্প-কবিতার সমাধান
শিক্ষার্থীরা, উপরে তোমাদের বাংলা মূল বই থেকে কুমড়ো ও পাখির কথা গল্পটি আলোচনা করা হয়েছে। এই অধ্যায়ের অনুশীলনীমূলক কাজগুলোর সমাধান পেতে উপরের উত্তরমালা অপশনে ক্লিক করো। এছাড়াও তোমাদের পরীক্ষা প্রস্তুতির জন্য অতিরিক্ত বেশকিছু প্রশ্ন দেওয়া হয়েছে। এ প্রশ্নগুলো খুব ভালোভাবে অনুশীলন করার পরামর্শ থাকবে।
Discussion about this post