কোর্সটিকার স্বাস্থ্য পাতায় এর পূর্বের আলোচনায় আমরা চেহারা সুন্দর করার বিভিন্ন উপায় নিয়ে কথা বলেছিলাম। আজ আমরা কোন খাবার খেলে চেহারা সুন্দর হয় অর্থাৎ শুধুমাত্র এমন কিছু খাবারের ওপর আলোকপাত করবো, যা আপনার চেহারা সুন্দর করতে কার্যকরী ভূমিকা রাখে।
খাবার সৃষ্টিকর্তার দেওয়া অশেষ একটি নেয়ামত। এই খাবার খেয়ে আমরা জীবনধারণ করি, আবার এ খাবার দিয়েই আমরাদের চেহারা সৌন্দর্য বৃদ্ধি করতে পারি। আমাদের হাতের নাগালেই রয়েছে এমন সব সহজলভ্য খাবার, যা আমাদের চেহারায় সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে দারুণ সাহায্য করে।
কোন খাবার খেলে চেহারা সুন্দর হয়
পুষ্টিবিদরা বলেন, সঠিক খাবার ত্বকের সমস্যা থেকে মানুষকে বাঁচাতে সাহায্য করে। এমন কিছু খাবার রয়েছে যা আমাদের ক্ষুধা নিবারণর পাশাপাশি ত্বকের জন্যও বেশ উপকারী। এ খাবারগুলো আপনার হাতের কাছে থাকে। প্রতিদিনের মেন্যুতে এ খাবারগুলো রাখলে আপনার ত্বক পুষ্টি লাভ করবে, ত্বক হবে সুন্দর ও উজ্জ্বল। সেই খাবারগুলো কী কী? নিচের আলোচনায় আমরা আজ তাই জানবো।
১. পানি
জীবন ধারণের জন্য পানি অপরিহার্য একটি উপাদান। তবে ত্বক ভালো রাখতেও বেশি করে পানি পান করার বিকল্প নেই। একজন প্রাপ্তবয়ষ্ক মানুষের দৈনিক অন্তত দেড় থেকে দুই লিটার পানি বা পানিযুক্ত খাদ্য খাওয়া উচিত।
পানি ত্বকের ভাঁজ দূর করে টানটান রাখার পাশাপাশি শরীরে চিনি জমতে দেয় না। এটি শরীর থেকে বিষাক্ত উপাদান ঘামের মাধ্যমে বের করে দেয় পানি। পর্যাপ্ত পানি পেলে ত্বকের প্রতিটি অংশে থাকা কোষে পানি পৌঁছায় এবং ত্বক সজীব দেখায়। পরিমিত পানি খেলে ব্রণের উপদ্রবও কমে।
২. ডিম
ডিম খেলে হাড় শক্ত ও মজবুত হয় এবং ভাল থাকে। ডিমের রয়েছে যৌনশক্তি বৃদ্ধির ক্ষমতা।
পাশাপাশি ত্বকের রঙ সুন্দর করতেও ডিমের বেশ ভালো ভূমিকা রয়েছে। ডিমে রয়েছে উচ্চমাত্রার প্রোটিন, যা শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
প্রতিদিন অন্তত একটি ডিম খেলে শরীরে ভিটামিন ও মিনারেলের চাহিদা অনেকটাই পূরণ হয়। ভিটামিনে থাকা প্রোটিন এবং ভিটামিন ত্বক টানটান করে এবং রুক্ষতা দূর করে। শুধু তাই নয়, এটি দেহের কোষের কার্যক্রম ভালো রেখে শক্তি বাড়াতে সাহায্য করে। তাই প্রতিদিন খাবার তালিকায় একটি ডিম রাখুন।
৩. ভিটামিন-সি
ত্বকের সজীবতার ধরে রাখতে ভিটামিন-সি যুক্ত খাবার গ্রহণ করার প্রয়োজন। বিশেষ করে বিভিন্ন প্রকার ভিটামিন-সি সমৃদ্ধ ফল যেমন- পেয়ারা, পেঁপে, আনারস, কামরাঙ্গা ইত্যাদি খেতে হবে। এ জাতীয় ফল ত্বককে ভালো রাখে এবং সহজে বয়সের ছাপ পড়তে দেয় না।
৪. লেবু জাতীয় ফল
লেবুর শরবত আমরা অনেকেই পছন্দ করি। গরমে লেবুর ঠাণ্ডা শরবত প্রাণ জুড়িয়ে দেয়। তবে লেবু এখন শুধুমাত্র পানীয় না, রূপচর্চায়ও এর দারুণ ভূমিকা রয়েছে। বিভিন্ন প্রকার লেবু জাতীয় ফল যেমন- লেবু, কমলা, মোসাম্বি, জাম্বুরা, মাল্টা এগুলো ত্বকের উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি করতে দারুন কার্যকরী।
এ ফলগুলোতে রয়েছে ভিটামিন সি, অ্যান্টি অক্সিডেন্ট এবং প্রয়োজনীয় ভিটামিন, যা স্কিনকে হাইড্রেটেট রাখে আর প্রাকৃতিকভাবে ত্বক উজ্জ্বল করতে সাহায্য করে। নিয়মিত ভিটামিন সি মুখ থেকে ব্রণের দাগ দূর করে। তাই ভিটামিনের ঘাটতি পূরণে লেবু জাতীয় ফল গ্রহণ অনিবার্য।
তবে হ্যাঁ, ফলের জুস খাওয়ার সময় অবশ্যই দোকানে থেকে কেনা প্যাকেটজাত জুস না কিনে বাসায় তৈরি করে নিতে হবে। কেননা, বাজারে বিক্রি জুসগুলো দীর্ঘদিন সংরক্ষণের জন্য প্রিজারভেটিভ দেওয়া থাকে। যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।
৫. সালাদ
আমাদের দেশে প্রচুর সতেজ শাক-সবজি পাওয়া যায়। ফলে এখানে সালাদের জনপ্রিয়তা রয়েছে বেশ। আপনি যদি সতেজ এবং স্বাস্থ্যজ্জ্বল ত্বক ধরে রাখতে চান, তাহলে নিয়মিত বিভিন্ন ধরনের সবজির সালাদ খেতে পারেন। সালাদে রয়েছে ফাইবার ও অ্যান্টি অক্সিডেন্ট, যা ত্বকের পুষ্টির অভাব পূরণ করে।
চেহারার উজ্জ্বলতা বৃদ্ধিতে আপনি সবজি দিয়ে তৈরি বিভিন্ন সালাদ খেতে পারেন। যেসব সালাদ ত্বক ভালো রাখে গ্রিন ভেজিটেবিল সালাদ, মিট-ভেজিটেবিল সালাদ, এবং ক্যাবেজ-ক্যারোট সালাদ এর মধ্যে অন্যতম। এই প্রতিটি সালাদ তৈরির প্রণালীই আপনি কোর্সটিকায় পেয়ে যাবেন।
৬. গ্রীন টি
শুকিয়ে যাওয়া ত্বকের যত্নে বিশেষজ্ঞরা গ্রীন টি বা সবুজ চা পানের পরামর্শ দিয়ে থাকেন।গ্রিন টি’র পলিফেনল শরীরের ফ্যাট অক্সিডেশন প্রক্রিয়াকে আরও কার্যকর করে খাবার থেকে ক্যালোরি তৈরির প্রক্রিয়ায় সাহায্য করে। ফলে দেহে অতিরিক্ত চর্বি জমতে পারে না। এছাড়াও গ্রীন টিতে রয়েছে অ্যান্টি অক্সিডেন্ট যা চেহারার বলি রেখা বা কালচে দাগ পড়া হতে বিরত রাখে।
পাশাপাশি ডিপ্রেশন দূর করতে গ্রীন টি খুবই কার্যকরী। এ ধরনের চা পাতায় ‘থিয়ানিন’ নামের অ্যামাইনো এসিড থাকে। এই উপাদান অবসাদ কমাতে সাহায্য করে। তাই নিয়মিত গ্রিন টি পান করলে অবসাদ থেকে দ্রুত মুক্তি পাওয়া সম্ভব।
৭. পেঁপে
পাকা পেঁপে ত্বকের কালো দাগ দূর করার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান। পাকা এক টুকরো পেঁপে নিয়ে আক্রান্ত স্থানে ভালো করে ঘষে দিন। আধা ঘণ্টা রাখুন, তারপর পানি দিয়ে ধুয়ে নিন। সপ্তাহে ৩/৪ বার এভাবে করতে থাকেন। পেঁপেতে থাকা প্যাপিন মরা কোষ দূর করে ত্বকের রঙ উজ্জ্বল করে তোলে।
পেঁপে ত্বকের মৃত কোষ দূর করে দেয় এবং তার সাথে চেহারা থেকে কালচে দাগগুলোকে দূর করে। শরীরে অবসাদজনিত ক্লান্তি, একটা মনমরা ভাব, পড়াশোনা বা কাজকর্মে অনীহা প্রভৃতি উপসর্গ দেখা দিলে এক্ষেত্রে পেঁপে খুবই ফলপ্রসূ। কাঁচা বা পাকা যে অবস্থায়ই হোক সকালে ও বিকেলে প্রতিদিন কয়েক টুকরো করে খেলে দেহে তারুণ্য বজায় থাকবে।
৮. গাজর
আপনি যদি কোন খাবার খেলে চেহারা সুন্দর হয় এটি নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন থাকেন, তবে গাজর আপনার জন্য অন্যতম উত্তর। ত্বকের সমস্যার সমাধানে নিয়মিত গাজর খাওয়া বেশ উপকারী। এটা বন্ধ লোমকূপ ও ব্রেক আউটের সমস্যা কমায়। গাজর ভিটামিন এ সমৃদ্ধ, যা অতিরিক্ত সিবাম নিঃসরণ কমায়। এটা আবন্ধ লোমকূপ পরিষ্কার করে ও ত্বকে উজ্জ্বলভাব আনে।
এছাড়াও, গাজর বিটা-ক্যারোটিন ও ক্যারোটিনয়েড সমৃদ্ধ যা প্রাকৃতিকভাবেই ‘ট্যান’ বা রোদপোড়া ভাব প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করে। তবে শুধু খাওয়ায়ই না, আপনি চাইলে রূপচর্চায়ও এই জাদুকরি উপাদান ব্যবহার করতে পারেন, এতে ত্বকের স্বাস্থ্য ভালো থাকবে।
৯. টমেটো
টমেটো কাচা হোক বা পাকা, স্বাস্থ্যর জন্য উভয়েরই গুরুত্বের শেষ নেই। তবে উজ্জ্বল ও তারুণ্যময় ত্বক পেতে চাইলে রান্না করা টমেটো খাওয়া যেতে পারে। অনেকেই রূপচর্চায় তাজা টমেটো ব্যবহার করেন। খাবারে রান্না করা টমেটো যোগ করা জাদুকরি পুষ্টি-লাইপোসিন সরবারহ করে যা ত্বকের নানা রকম সমস্যা যেমন- ত্বক ঝুলে পড়া, বলিরেখা ও বয়সের ছাপ কমায়।
তবে অবশ্যই সেরা এবং সতেজ টমেটো খেতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে যে, কোন অবস্থাতেই যেন প্রক্রিয়াজাত, চিনি বা লবণ দিয়ে সংরক্ষণ করা টমেটো না হয়। এতে উপকারের চেয়ে অপকারই বেশি হবে।
১০. দুধ
দুধকে বলা হয় আদর্শ খাদ্য, কেননা এতে সব ধরনের খাদ্যগুণ আছে। দুধে ল্যাকটিক এসিড থাকে, যা ত্বকে উজ্জ্বল করতে সহায়তা করে। আর দুধে থাকা প্রোটিন ত্বকের কোলাজেন বুস্ট করতে দরকারি ভূমিকা রাখে। প্রতিদিন অন্তত ২ গ্লাস করে দুধ পান করলে ত্বকে বার্ধক্যের ছাপ পড়ে না। এছাড়াও দরকারি মিনারেলস আর পুষ্টি উপাদান সবই রয়েছে প্রাকৃতিক দুধে। তাই ত্বকের উজ্জ্বলতা ধরে রাখতে প্রতিদিন খাবার তালিকায় দুধ বা দুগ্ধজাত খাবার রাখুন।
যে খাবারগুলো খাওয়া উচিত না
অতিরিক্ত লবণ: অনেকেই খাবারের সাথে কাঁচা লবণ খান। আবার কেউ কেউ রান্নার সময় তরকারিতেও বেশি লবণ খেয়ে থাকেন। অতিরিক্ত লবণ খেলে ত্বকে ফোলা ভাব আসে। ফলে মুখ ফোলা ফোলা লাগে এবং চেহারায় ক্লান্তির ছাপ পড়ে।
চকলেট: চকলেট, ক্যান্ডি বা মিষ্টান্ন জাতীয় খাবার দেহের স্থূলতার বড় একটি কারণ। এগুলো গ্রহণে শরীর মোটা হয়ে গেলে আমাদের ত্বকের উপর টান পড়ে ফলে ত্বক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। একই সাথে এসব খাবারে বিদ্যমান চিনি ত্বকে প্রদাহ সৃষ্টি করে।
ভাজা পোড়া খাবার: স্ট্রিট ফুড দেখে আমরা অনেকেই লোভ সামলাতে পারি না। কিন্তু অতিরিক্ত গরম তেলে কড়া করে ভাজা পোড়া খাবার ত্বকের জন্য খুবই ক্ষতিকর। অতিরিক্ত গরম তেলে খাবার ভাজলে হাইড্রোজেনাটেড ফ্যাট উৎপন্ন হয় যা ফ্যাটি এসিডের অক্সিডেসন ঘটায় এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট (ভিটামিন ই, ওমেগা ফ্যাট ৩) ধ্বংস করে। ফলে ত্বকের সজীবতা হারিয়ে যায় এবং অনেক ক্ষেত্রে ব্রণের উপদ্রব হয়।
মশলা জাতীয় খাবার: চিপস, চানাচুর বা মশলা জাতীয় খাবার আমাদের দেহে লবণের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। ফলে দেহে পানির পরিমাণ কমে যায়। এতে ত্বক দ্রুত শুকিয়ে যায় এবং রুক্ষ হয়ে পড়ে।
লাল মাংস: গরু কিংবা খাসীর মাংস যেটিই আপনি পছন্দ করেন না কেন, এটি অতিমাত্রায় খাওয়া উচিত না। অতিরিক্ত লাল মাংস খেলে ত্বকে বিরূপ প্রভাব পরে। লাল মাংসে আছে স্যাচুরেটেড ফ্যাট যা অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলে এবং ত্বকের সৌন্দর্য কমিয়ে দেয়।
অতিরিক্ত ক্যাফেইন: প্রতিদিন দুই থেকে তিন কাপ চা খাওয়া যায়। কিন্তু এর থেকে বেশি চা কিংবা কফি খেলে ত্বকের ক্ষতির হয়। অতিরিক্ত ক্যাফেইন শরীরে কর্টিসলের উৎপাদন বাড়িয়ে দেয় যা খুব সহজেই বুড়িয়ে ফেলে ত্বক। এছাড়াও এটি ত্বককে পাতলা করে ফেলে এবং সহজেই ভাঁজ ফেলে দেয়।
অ্যালকোহল: অ্যালকোহল গ্রহণে ত্বকে বার্ধক্যের দাগ সৃষ্টি হয়। অ্যালকোহল শরীরে এন্টি-ডিউরেটিক হরমোনের ক্ষতি করে এবং রক্তের উদ্দীপনা বাড়িয়ে দেয়। ফলে পানির তৃষ্ণা বেড়ে যায়। আর পানি শূন্যতার ফলে আমাদের ত্বক খসখসে হয়ে যায়।
শেষ কথা
ত্বকের বাহ্যিক সৌন্দর্য নির্ভর করে দেহের ভেতরের সুস্থতার উপর। অর্থাৎ আপনি যদি ভেতরে ভেতরে অসুস্থ্য থাকেন, তার পূর্ণ ছাপ আপনার চেহারায় পড়বেই। তাই কোন খাবার খেলে চেহারা সুন্দর হয় তা দৈনন্দিন জীবনে গ্রহণ করুন।
ত্বকের জন্য উপকারী খাবারগুলো নিয়মিত গ্রহণ করুন এবং প্রচুর পানি পান করুন। এর ফলে আপনার ত্বক কোনো রকমের প্রসাধনী ছাড়াই হয়ে উঠবে উজ্জ্বল ও লাবণ্যময়। পাশাপাশি এ খাবারগুলোর বেশ সহজলভ্য এবং দামের দিক হতেও ব্যায়বহুল নয়। সেই দিক থেকে আপনার অর্থও সাশ্রয় হচ্ছে।
Discussion about this post