চুলে খুশকি অন্যতম বড় এবং বিরক্তিকর একটি সমস্যা। খুশকি হলে মাথায় প্রচণ্ড চুলকানির সাথে সাথে চুল ঝড়ে পড়ারও সম্ভাবনা রয়েছে। আর তাই জানতে হবে চিরতরে খুশকি দূর করার উপায় । মাথার ত্বকে অতিরিক্ত এক ধরণের ফাঙ্গাস হওয়ার কারণে খুশকি সমস্যা হয়ে থাকে।
প্রাকৃতিক নিয়ম অনুযায়ী আমাদের মাথার ত্বক বা স্কাল্পে কিছু নতুন কোষ উৎপন্ন হয় এবং পুরোনোগুলো ঝড়ে যায়। এই প্রক্রিয়াটি সাধারণ চক্র হিসেবে চলতে থাকে। আর এই পুরোনো মৃত কোষগুলো যখন ত্বকের সাথে জমে যায় এবং সাদা আঁশের মত অস্তিত্ব প্রকাশ করে, আমরা তখন একে খুশকি বলি।
খুশকি দীর্ঘদিন মাথায় থাকলে প্রচণ্ড চুলকানির সৃষ্টি হয় এবং এর থেকে চুল ঝড়ে পড়া এবং মাথায় ক্ষতস্থান তৈরির সম্ভাবনা থাকে। তাই আমাদের উচিত যথাশীঘ্র খুশকি দূর করার উপায় খুঁজে বের করা এবং সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া।
মাথায় খুশকি হওয়ার কারণ কি?
খুশকি অনেকের কাছে দুশ্চিন্তার বিষয় হলেও এটি কোনো রোগ বা রোগের লক্ষণ নয়। মাথার ত্বকের পুরোনো মৃত কোষগুলো জমে এবং ছত্রাকের প্রভাবে খুশকি হয়ে থাকে। এছাড়াও মাথায় খুশকি হওয়ার আরো বেশকিছু কারণ রয়েছে। চলুন, সেগুলো জানি।
১. রুক্ষ-শুষ্ক ত্বক
শীতে আবহাওয়ায় আর্দ্রতা কমে যাওয়ায় দেহের ত্বকের পাশাপাশি মাথার ত্বকও রুক্ষ ও শুষ্ক হয়ে যায়। এর ফলে শীতের সময়টিতে মাথায় খুশকি বেশী হয়ে থাকে। এছাড়া এ সময় বাইরের ঠান্ডা বাতাস ও ঘরের তুলনামূলক গরম বাতাসের ফলে তাপমাত্রার যে সামাঞ্জস্যহীনতা দেখা যায়, সেটিও খুশকি হওয়ার অন্যতম কারণ।
২. অতিরিক্ত তেল ব্যাবহার
একটি গবেষণায় দেখা গেছে, যারা মাথায় অতিরিক্ত তেল ব্যবহার করেন তাদের খুশকি সংক্রমণের ঝুঁকি অন্যদের তুলনায় বেশি থাকে। মাত্রাতিরিক্ত তেল ব্যবহারের ফলে তেল স্তুপ আকারে চুলের গোড়ায় জমা হয়ে পরবর্তীতে সেখানে ছত্রাকের প্রাদুর্ভাব ঘটায়। এর ফলে মাথায় খুশকির পরিমাণ বৃদ্ধি পায়।
৩. চুল যথেষ্ট যথেষ্ট না নেয়া
অনেকেই নিয়মিত চুল আঁচরান না। যদি চুল কম আঁচড়ানো হয় তাহলে মাথার ত্বকের মৃত কোষগুলো ঝড়ে যাওয়ার প্রবণতা অনেক কমে যায়। ফলে এগুলো ঝড়ে না পড়ে বরং চুলের গোড়ায় জমা হয়ে থাকে। এর ফলে খুশকির তৈরির হয় অন্যদিকে চুলে পর্যাপ্ত পরিমাণে শ্যাম্পু না করলে মাথার ত্বক অপরিষ্কার থাকে। এর ফলেও মাথায় খুশকি উৎপন্ন হতে পারে।
৪. রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়া
দেহে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গেলে খুশকির প্রবণতা বেশি হয়ে থাকে। বিশেষ কিছু রোগ যেমন- পারকিন্সন ডিসিস, হৃদরোগ, স্ট্রোক, সেন্সিটিভ ত্বক ও ত্বকের সমস্যা (সোরিয়াসিস, একজিমা) ইত্যাদি যাদের রয়েছে তাদেরও খুশকির প্রবণতা বেশি লক্ষ্য করা যায়।
গবেষণায় পাওয়া যায়, যে ১০.৬% মানুষ যাদের HIV আছে তাদের খুশকির সমস্যা বেশি হয়ে থাকে। এছাড়াও খাদ্যাভাসের অনিয়মের কারণেও খুশকি হয়ে থাকে। আপনার খাবারে পর্যাপ্ত পরিমাণে ভিটামিন বি ও জিংক না থাকলে খুশকি হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। পাশাপাশি অধিক পরিমাণে চর্বি জাতীয় খাদ্য গ্রহণ করলেও খুশকি হতে পারে।
৫. অন্যান্য কারণ
অতিরিক্ত মানসিক চাপ খুশকি সমস্যার একটি অন্যতম কারণ। অনেকসময় পানির সমস্যার কারণেও খুশকি হতে পারে। ক্লোরিনের পরিমাণ বেশি আছে এমন পানি দিয়ে গোসল করলে ত্বক তাড়াতাড়ি শুষ্ক হয়ে যায়। যা মাথায় খুশকির কারণ হয়ে উঠতে পারে।
আমাদের সকলের স্ক্যাল্পেই ম্যালেসেজিয়া নামের এক ধরণের ফাঙ্গাস পরিমাণমত থাকে এবং এটি তেমন কোন সমস্যার সৃষ্টি করে না। তবে এ ফাঙ্গাসের পরিমাণ অতিরিক্ত হারে বেড়ে গেলে তা ত্বকের ক্ষরিত তেল শোষণ করে নেয়। এর ফলে স্ক্যাল্প অতিরিক্ত ত্বকীয় কোষ উৎপাদন করে থাকে। এ সকল অতিরিক্ত কোষ মৃত হলে স্ক্যাল্প ও চুলের তেলের সাথে মিশে খুশকির সৃষ্টি করে।
খুশকি দূর করার উপায়
খুশকি দূর করার উপায় হিসেবে বাজারে প্রচলিত প্রচুর প্রোডাক্ট থাকলেও প্রাকৃতিক কিছু নিয়ম অনুসরণ করেও আপনি কার্যকরী ফলাফল পেতে পারেন। এর ফলে আপনাকে কোন প্রকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার সম্মুখিন হতে হবে না।
১. নারকেল তেল ব্যবহার করুন
একাধিক স্বাস্থ্য সুবিধার জন্য সুপরিচিত নারকেল তেল খুশকির জন্যও দারুণ একটি প্রাকৃতিক প্রতিকার হিসাবে ব্যবহৃত হয়। নারকেল তেল ত্বকের হাইড্রেশন উন্নত করতে এবং শুষ্কতা রোধে সহায়তা করতে পারে যা খুশকি দূর করতে সহয়তা করে।
যুক্তরাষ্ট্রের National Library of Medicine এর একটি গবেষণায় দেখা গেছে, নারকেল তেল ত্বকের হাইড্রেশন উন্নত করতে খনিজ তেলের মতো কার্যকর ভূমিকার রাখে। অন্যান্য গবেষণায়ও নারকেল তেলের একজিমার চিকিৎসা সহায়তা খুঁজে পাওয়া যায়। এটি ত্বকের এমন একটি অবস্থা যা খুশকি দমনে অবদান রাখতে পারে।
২. অ্যালোভেরা ব্যবহার করুন
ত্বকের সুরক্ষায় অ্যালোভেরার ব্যবহার প্রাচীনকাল থেকেই হয়ে আসছে। অ্যালোভেরা এমন একটি প্রাকৃতিক উপাদান যা আপনার রুক্ষ-শুষ্ক ত্বককে সর্বোচ্চ সুবিধা দিতে পারে। এটি পোড়া, ঘা এবং সোরিয়াসিসের মতো সমস্যায়ও সফলভাবে কাজ করে।
আমরা আগেই জেনেছি ম্যালেসেজিয়া নামের এক ধরণের ফাঙ্গাস আমাদের মাথায় খুশকির উদ্ভব ঘটায়। অ্যালোভেরার এ সকল অ্যান্টিব্যাক্টেরিয়াল এবং অ্যান্টিফাঙ্গাল বৈশিষ্ট্যগুলো খুশকি থেকে রক্ষা করতে পারে।
একইভাবে, একটি টেস্ট-টিউব সমীক্ষায় দেখা গেছে যে অ্যালোভেরা বেশ কয়েকটি প্রজাতির ছত্রাকের বিরুদ্ধে কার্যকর ছিল এবং মাথার ত্বকে চুলকানির কারণ ছত্রাকের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করতে পারে।
৩. মানসিক চাপ কমান
মানসিক চাপ স্বাস্থ্য এবং সুস্থতাকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে। এটি দীর্ঘস্থায়ী ক্রমান্বয়ে দীর্ঘস্থায়ী হলে মানসিক স্বাস্থ্য বিপর্যস্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। খুশকি তৈরির ক্ষেত্রে মানসিক চাপ বা স্ট্রেসের প্রত্যক্ষ ভূমিকা নেই। তবে এটি শুষ্কতা এবং চুলকানির মতো লক্ষণগুলো বাড়িয়ে তুলতে পারে, যা পরবর্তীতে খুশকি রূপে দেখা দেয়।
দীর্ঘমেয়াদী উচ্চ পর্যায়ের স্ট্রেস ব্যক্তির রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে দুর্বল করে দেয়। এর ফলে আপনার শরীরে কিছু ছত্রাকের সংক্রমণ এবং ত্বকের অবস্থার সাথে লড়াইয়ের ক্ষমতা হ্রাস পায়, যা পারে যা খুশকির সৃষ্টি করতে পারে। আর এ জন্য মানসিক চাপকে খুশকির অন্যতম একটি সম্ভাব্য কারণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
৪. চা গাছের তেল ব্যবহার করে দেখুন
ঐতিহাসিকভাবে চা গাছের তেল ব্রণ থেকে সোরিয়াসিস পর্যন্ত অসুস্থতার চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত হয়। এটি শক্তিশালী অ্যান্টি-মাইক্রোবিয়াল এবং অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। যা খুশকির লক্ষণগুলো হ্রাস করতে সহায়তা করতে পারে।
গবেষণা বলছে, চা গাছের তেল ছত্রাকের নির্দিষ্ট স্ট্রেনের বিরুদ্ধে লড়াই করতে কার্যকর ভূমিকা রাখে।
একটি গবেষণাকারী দল ৪ সপ্তাহের পরীক্ষায় চা গাছের তেল প্রতিদিন ১২৬ জনের মাথায় প্রয়োগ করে এর প্রভাব লক্ষ্য করে। দেখা যায়, চা গাছের তেল খুশকি লক্ষণগুলোর তীব্রতা ৪১% হ্রাস করে এবং চুলকানি কমিয়ে দেয়।
৫. রুটিনে অ্যাপল সিডার ভিনেগার নিন
অ্যাপল সিডার ভিনেগার বিভিন্ন ধরণের স্বাস্থ্য সুবিধার জন্য অনেক পরিচিত। এর মধ্যে রয়েছে ইনসুলিন সংবেদনশীলতা উন্নতিকরণ এবং ওজন হ্রাস বৃদ্ধি করা। অ্যাপল সিডার ভিনেগার প্রায়ই খুশকি থেকে মুক্তি পেতে প্রাকৃতিক প্রতিকার হিসাবে কাজ করে।
একটি টেস্ট-টিউব সমীক্ষায় দেখা যায় যে, অ্যাপল সিডার ভিনেগার এবং এর যৌগগুলো নির্দিষ্ট ধরণের ছত্রাকের বৃদ্ধি প্রতিরোধ করতে পারে। ভিনেগারের অম্লতা মাথার ত্বকে মৃত ত্বকের কোষগুলো দ্রুত ঝড়ে পড়তে সহায়তা করে। এটি ছত্রাকের বৃদ্ধি কমাতে ত্বকের pH বজায় রাখে এবং এভাবে খুশকির সাথে লড়াই করে।
আপনি যদি আপেল সিডার ভিনেগার ব্যবহার করে দেখতে চান তবে আপনার শ্যাম্পুতে কয়েক টেবিল চামচ যুক্ত করতে পারেন। অথবা এটি অন্যান্য প্রয়োজনীয় তেলের সাথে একত্রিত করে বা সরাসরি চুলে স্প্রে করতে পারেন।
খুশকি দূর করার আরো কিছু উপায়
- যাদের প্রায়ই খুশকি হয় তারা নিয়মিত চুলে পরিমিত শ্যাম্পু ব্যবহার করতে পারেন।
- বাইরে বের হলে ধুলোবালি থেকে রক্ষার জন্য মাথায় স্কার্ফ বা ওড়না ব্যবহার করা যেতে পারে।
- চুলের খুশকি নিয়ন্ত্রণে খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন একটি গুরুত্বপুর্ণ বিষয়। এজন্য মাথার ত্বক ভালো রাখতে প্রচুর পরিমাণে শাকসবজি খাওয়াসহ অতিরিক্ত চর্বিজাতীয় খাবার পরিহার করতে হবে।
- চুল অপরিষ্কার থাকলে খুশকি বেশি হয়। তাই নিয়মিত চূল পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখার চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।
- গোছলের পর যত দ্রুত সম্ভব চুল ভালো করে মুছে নিতে হবে। তবে চুল শুকানোর জন্য হেয়ার ড্রায়ার ব্যবহার না করে ফ্যানের বাতাসে শুকিয়ে নেওয়া ভালো।
►► আরো দেখো: ত্বকের যত্নে শশার ফেসপ্যাক ব্যবহার
►► আরো দেখো: তৈলাক্ত ত্বকের যত্নে লেবুর ৩ টি ফেইসপ্যাক
শেষ কথা
খুশকি হলে দ্রুত তার প্রতিকার করা প্রয়োজন। নইলে এই সমস্যা থেকে চুল পড়াসহ নানা সমস্যা তৈরি হতে পারে। তাই খুশকি প্রতিরোধে প্রাকৃতিক উপাদান ও শ্যম্পু ব্যবহারের পাশাপাশি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকা ও খাবারের বিষয়েও সমান মনযোগী হওয়া অতীব জরুরি।
Photo by Getty Image
Discussion about this post