গণঅভ্যুত্থানের কথা সৃজনশীল প্রশ্ন উত্তর : শাসকশ্রেণি যখন সুশাসন বাদ দিয়ে অত্যাচারী হয়ে ওঠে, তখন নির্যাতিত-নিপীড়িত জনতা বিদ্রোহ করে; শাসক এবং শাসন পদ্ধতির বিরুদ্ধে শুরু করে আন্দোলন-সংগ্রাম। সর্বস্তরের মানুষের আন্দোলনের মুখে স্বৈরশাসক যখন গণদাবি মেনে নেয় বা ক্ষমতা থেকে সরে যেতে বাধ্য হয়, তখন আমরা সে আন্দোলনকে বলি গণঅভ্যুত্থান।
বাংলাদেশের নিকট ইতিহাসে তিনটি বড় গণঅভ্যুত্থান সংগঠিত হয়েছে- ১৯৬৯ সালে আইয়ুব খানের, ১৯৯০ সালে জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের এবং ২০২৪ সালে শেখ হাসিনার শাসনের বিরুদ্ধে। ১৯৬৯ ও ১৯৯০ সালের আন্দোলনের নেতৃত্ব ছিল রাজনৈতিক দলগুলোর হাতে, কিন্তু ২০২৪ সালের আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছে শিক্ষার্থীরা।
কিন্তু স্বৈরশাসকের পতনই শেষ কথা নয়। সুন্দর, সমৃদ্ধ ও মানবিক বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হলে দেশের প্রত্যেক নাগরিককে দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে আন্তরিক হতে হবে; তাহলেই শহিদ ও আহতদের ত্যাগ সার্থক হবে।
গণঅভ্যুত্থানের কথা সৃজনশীল প্রশ্ন উত্তর
সৃজনশীল—১ : ১৭৮৯ সালের ১৪ই জুলাই ফরাসি রাজতন্ত্রের দমননীতির প্রতীক বাস্তিল দুর্গের পতনের মধ্য দিয়ে ফরাসি বিপ্লব সংঘটিত হয়। রাজপুরুষদের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে যারা প্রতিবাদ করতো তাদের এই বাস্তিল দুর্গে বন্দি করে নির্যাতন করা হতো।
শত শত বছরের সেইসব নির্যাতন, নিপীড়ন, সামাজিক বঞ্চনা, অর্থনৈতিক অনাচারসহ বহুমাত্রিক শোষণের বিরুদ্ধে এই বিপ্লব ছিল ভুক্তভোগী সাধারণ মানুষের পুঞ্জিভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। দার্শনিক জঁ-জ্যাক রুশো ছিলেন এই আন্দোলনের মূল প্রবক্তা; আর ফরাসি বিপ্লবকে সফল করেছে ব্যবসায়ী, কারিগর, কৃষক-শ্রমিকসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার দরিদ্র মানুষের সক্রিয় অংশগ্রহণ। অনেক মৃত্যুর বিনিময়ে জনতার জয় হয়, ফ্রান্স মুক্তি পায় রাজতন্ত্রের কবল থেকে।
ক. ১১ দফা দাবি উত্থাপন করে কোন সংগঠন?
খ. ‘গণঅভ্যুত্থান; বলতে কী বোঝায়?
গ. উদ্দীপকের ‘ফরাসি বিপ্লব’ কী ধরনের আন্দোলন? তোমার পাঠ্য ‘গণঅভ্যুত্থানের কথা’ প্রবন্ধের আলোকে ব্যাখ্যা করো।
ঘ. উদ্দীপকের ফরাসি বিপ্লবে আন্দোলনকারীদের ভূমিকার সঙ্গে ‘গণঅভ্যুত্থানের কথা’ প্রবন্ধে উল্লেখিত বাংলাদেশের তিনটি গণঅভ্যুত্থানের আন্দোলনকারীদের ভূমিকার তুলনা করো।
১ নম্বর সৃজনশীল প্রশ্নের উত্তর
ক. সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ঐতিহাসিক ১১ দফা দাবি (১৯৬৯ সালের ৪ঠা জানুয়ারি) উত্থাপন করেন।
খ. ‘গণঅভ্যুত্থান’ বলতে বোঝায় এমন এক ধরনের আন্দোলন বা বিদ্রোহ, যেখানে সাধারণ জনগণ শাসকের অন্যায়, অত্যাচার, বৈষম্য ও অমানবিক দমননীতির বিরুদ্ধে সংগঠিত হয়ে সর্বস্তরের মানুষের সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে শাসককে তাদের দাবি মেনে নিতে বা ক্ষমতা থেকে সরে যেতে বাধ্য করে। এটি সাধারণত শান্তিপূর্ণ পন্থায় শুরু হলেও শাসকের দমননীতি ও সহিংসতার কারণে আন্দোলন অনেকসময় রক্তক্ষয়ী রূপ ধারণ করে।
গ. উদ্দীপকের ‘ফরাসি বিপ্লব’ একটি গণআন্দোলন বা গণঅভ্যুত্থানের উদাহরণ। এটি ছিল ফ্রান্সের সাধারণ মানুষের দুঃশাসন, শোষণ এবং রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। জনগণের পুঞ্জিভূত ক্ষোভ ও বঞ্চনার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে এই বিপ্লব বাস্তিল দুর্গের পতনের মাধ্যমে একটি বৃহৎ সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তন নিয়ে আসে।
গণঅভ্যুত্থান তখনই সংঘটিত হয়, যখন কোনো শাসক তাদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়ে অত্যাচারী হয়ে ওঠে এবং জনগণের অধিকারের প্রতি উদাসীন থাকে। ফরাসি বিপ্লবের সময় রাজতন্ত্র সাধারণ মানুষের ওপর নানা নিপীড়ন চালিয়েছে, যা উদ্দীপকে বর্ণিত। ‘গণঅভ্যুত্থানের কথা’ প্রবন্ধে উল্লেখিত ১৯৬৯, ১৯৯০ এবং ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানগুলোতেও শাসকের দমননীতি ও শোষণের বিরুদ্ধে মানুষ রাস্তায় নেমেছে।
ফরাসি বিপ্লবে ব্যবসায়ী, কারিগর, কৃষক-শ্রমিকসহ বিভিন্ন শ্রেণির দরিদ্র মানুষ সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিল। তেমনই ১৯৬৯-এর অভ্যুত্থানে ছাত্র, কৃষক, শ্রমিক ও মেহনতি মানুষ এবং ২০২৪-এর অভ্যুত্থানে সর্বস্তরের মানুষ অংশগ্রহণ করেছিল।
ফরাসি বিপ্লবের আদর্শ ছিল সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতা। ‘গণঅভ্যুত্থানের কথা’ প্রবন্ধের ২০২৪ সালের অভ্যুত্থানের লক্ষ্যও ছিল একটি বৈষম্যহীন, মানবিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ প্রতিষ্ঠা।
ফরাসি বিপ্লবে যেমন অসংখ্য মানুষ মৃত্যুবরণ করেছিল, গণঅভ্যুত্থানের কথায় বর্ণিত প্রতিটি আন্দোলনেও অসংখ্য মানুষ আত্মবলিদান করেছেন।
তাই সবশেষে বলা যায় যে, ফরাসি বিপ্লব ও প্রবন্ধে বর্ণিত গণঅভ্যুত্থান উভয়ই শাসকের দমননীতি এবং জনগণের অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে জনতার সক্রিয় অংশগ্রহণের উদাহরণ। এ ধরনের আন্দোলন গণমানুষের চেতনার প্রকাশ এবং ঐক্যের মাধ্যমে শোষণ থেকে মুক্তির পথ তৈরি করে।
ঘ. উদ্দীপকের ফরাসি বিপ্লবে আন্দোলনকারীদের ভূমিকা ও ‘গণঅভ্যুত্থানের কথা’ প্রবন্ধে উল্লেখিত বাংলাদেশের তিনটি গণঅভ্যুত্থানের আন্দোলনকারীদের ভূমিকার মধ্যে বেশ কিছু মিল এবং বৈশিষ্ট্যগত তুলনা করা যায়। উভয় ক্ষেত্রেই আন্দোলনকারীরা শোষণ, দমননীতি, এবং বৈষম্যের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে লড়াই করেছেন এবং দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন এনেছেন।
ফরাসি রাজতন্ত্রের দমননীতি ও সামাজিক-অর্থনৈতিক শোষণের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ প্রতিবাদে অংশ নেয়। বাস্তিল দুর্গ ছিল শোষণ ও অত্যাচারের প্রতীক, যার পতন আন্দোলনের বিজয় ঘোষণা করে। তেমনিভাবে বাংলাদেশের গণঅভ্যুত্থানগুলোতেও অত্যাচারী শাসকের বিরুদ্ধে জনতা বিদ্রোহ করেছে।
১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে আইয়ুব খানের বৈষম্যমূলক শাসন এবং ১৯৯০-এর গণঅভ্যুত্থানে এরশাদের স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে আন্দোলন হয়েছিল। ২০২৪ সালের অভ্যুত্থানও শেখ হাসিনার দমননীতি ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়।
উদ্দীপকে দেখা যায় যে, ফরাসি বিপ্লবে ব্যবসায়ী, কারিগর, কৃষক, শ্রমিকসহ বিভিন্ন শ্রেণির দরিদ্র মানুষ সক্রিয়ভাবে বিপ্লবে অংশগ্রহণ করে। ঠিক তেমনি ১৯৬৯-এর অভ্যুত্থানেও ছাত্র, কৃষক, শ্রমিক এবং সর্বস্তরের মানুষ অংশগ্রহণ করে। ১৯৯০ সালের অভ্যুত্থানেও ছাত্র-জনতা, পেশাজীবী, শ্রমিক সবাই অংশ নেয়। ২০২৪ সালে শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে রিকশাওয়ালা, শ্রমিক, অভিভাবকসহ সর্বস্তরের মানুষ আন্দোলনে যুক্ত হয়।
ফরাসি বিপ্লবের আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল রাজতন্ত্রের দুঃশাসন, অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং সামাজিক শোষণ থেকে মুক্তি। একইভাবে ১৯৬৯ সালে আইয়ুব খানের বৈষম্যমূলক নীতি, ১৯৯০ সালে এরশাদের স্বৈরতান্ত্রিক শাসন এবং ২০২৪ সালে শেখ হাসিনার দমনমূলক শাসনের বিরুদ্ধে জনগণ লড়াই করেছে।
ফরাসি বিপ্লব সফল করতে বহু মানুষ জীবন উৎসর্গ করে, তাদের আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে রাজতন্ত্রের পতন ঘটে। বাংলাদেশের গণঅভ্যুত্থানগুলোতেও অসংখ্য মানুষের আত্মত্যাগের ইতিহাস রয়েছে। ১৯৬৯ সালে আসাদ, মতিউর, জোহাসহ অনেকেই শহিদ হন। ১৯৯০ সালে নূর হোসেন এবং ২০২৪ সালে আবু সাঈদ ও মীর মুগ্ধের মতো অসংখ্য মানুষ জীবন দেন।
তাই বলা যায় যে, এই আন্দোলনগুলো প্রমাণ করে, জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ ও আত্মত্যাগের মধ্য দিয়েই সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তন সম্ভব।
আরও দেখো—অষ্টম শ্রেণির বাংলা সকল গল্প-কবিতার প্রশ্ন ও উত্তর
শিক্ষার্থীরা, উপরে তোমাদের বাংলা মূল বই থেকে গণঅভ্যুত্থানের কথা সৃজনশীল প্রশ্ন উত্তর নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এছাড়াও তোমাদের পরীক্ষা প্রস্তুতির জন্য অতিরিক্ত বেশকিছু সৃজনশীল প্রশ্ন দেওয়া হয়েছে। এ প্রশ্নগুলো খুব ভালোভাবে অনুশীলন করার পরামর্শ থাকবে। পিডিএফ ফরমেটে উত্তরমালা সংগ্রহের জন্য ‘Answer Sheet’ অপশনে ক্লিক করো।
Discussion about this post