চোখের সাদা অংশ লালচে হওয়া, চোখ দিয়ে পানি পড়া ও চোখে ব্যথা এই সবগুলো লক্ষণ যখন আমরা একসাথে দেখতে পাওয়া যায় তাকে আমরা চোখ উঠা বলে থাকি। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় একে কনজাঙ্কটিভাইটিস বলা হয়। চোখ উঠলে ১ সপ্তাহের মধ্যে সেটি এমনিতেই ভালো হয়ে যায়। এই সময়ে ঘরোয়া উপায়ে চোখ উঠলে করণীয় কি তা আজকের আর্টিকেলে বলা হয়েছে।
চোখ উঠা রোগটি ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া এর কারণে হয়ে থাকে। ভাইরাসজনিত হওয়ার কারণে এই রোগটি ছোঁয়াচে। যার ফলে এই রোগটি খুব দ্রুতই অন্যদের মাঝে ছড়িয়ে পড়তে দেখা যায়। চোখ উঠলে সেই ব্যক্তির ব্যবহৃত কোন জিনিসপত্র অন্য ব্যক্তি খেতে দূরে রাখতে হবে। নাহলে দেখা যাবে আস্তে আস্তে পুরো পরিবারের এই সমস্যা দেখতে পাওয়া যাবে।
চোখ উঠলে তার প্রভাবটা যেন ক্ষতিকর না হয় ও সমস্যা যাতে বৃদ্ধি না হয়ে প্রশমিত হয় তার জন্য যা যা করণীয় যা আপনাদের বলবো। এক সপ্তাহের মধ্যে আপনার চোখ উঠার সমস্যা সমাধান না হলে ডাক্তারের কাছে যাওয়া জরুরী।
চোখ উঠলে করণীয়
চিকিৎসকরা বলেন চোখ উঠলে বিচলিত না হয়ে ঘরে বসে প্রাথমিক চিকিৎসা নিতে। প্রাথমিক চিকিৎসা নেওয়ার মাধ্যমেই অধিকাংশ মানুষ এই রোগ থেকে আরোগ্য লাভ করে। প্রাথমিক চিকিৎসা নেওয়ার পাশাপাশি কিছু সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে নাহলে এই রোগের লক্ষণগুলো বৃদ্ধি পেতে থাকবে এবং সেই সাথে খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়বে।
প্রথমে আপনাকে বুঝতে হবে যে আপনার চোখ কি উঠেছে? যদি চোখ উঠার লক্ষণগুলোর সাথে আপনার লক্ষণগুলোর মিল পান তবে প্রাথমিক পর্যায়ে ধরে নিতে হবে যে আপনার চোখ উঠেছে। চলুন তার আগে জেনে নেওয়া যাক চোখ উঠার লক্ষণগুলো-
চোখ উঠার লক্ষণ
চোখ উঠার বিভিন্ন ধরনের কারণ রয়েছে। সেগুলোর উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন ধরনের লক্ষণ দেখতে পাওয়া যায়। তবে সবচেয়ে সাধারণ লক্ষণ হচ্ছে চোখের সাদা অংশ রক্তবর্ণ ধারন করা, অনেক সময় যেটি গোলাপি রঙেরও হয়ে থাকে। প্রথমে একটি চোখের সাদা অংশ লালবর্ণ ধারণ করে পরে অন্য চোখটিও আস্তে আস্তে আক্রান্ত হতে শুরু করে। আরও অন্যান্য যা যা লক্ষণ রয়েছে তা হলো-
- চোখ চুলকানো
- চোখ জ্বালাপোড়া ও খচখচে করা
- চোখ থেকে পানি পড়া
- চোখের পাতা ফুলে যাওয়া
- চোখ ব্যথা হওয়া
- আলো সহ্য না হওয়া
- চোখে পুঁজ জমা হওয়া
- কনট্যাক্ট লেন্স পড়লে অস্বস্তি হওয়া
- রাতে ঘুমানোর পরে পুঁজ জমে চোখের পাপড়ি জোড়া লেগে যাওয়া
- চোখের পাতা ফুলে গিয়ে চোখ ঝাপসা হয়ে আসা
যদি চোখ উঠার লক্ষণ গুলো আপনার নিজের লক্ষণগুলোর সাথে মিলে যায় তাহলে আপনি আগে নির্বাচন করুন আপনার চোখ উঠার পিছনে মূল কারণ টা কি। তারপর সেই অনুযায়ী চোখ উঠলে করণীয় এর কাজগুলো করতে শুরু করতে হবে।
চোখ ওঠার কারণ বের করুন
চোখ কেন উঠেছে তা নির্দিষ্ট করে বের করা একটু কঠিনই। চোখ উঠার বিভিন্ন কারণ থাকলেও, চোখ উঠার লক্ষণগুলো প্রায়ই একই। তবে কিছু লক্ষণের উপর ভিত্তি করে আমরা ধারণা করতে পারি যে ঠিক এই কারণে চোখ উঠছে। চোখ উঠার অনেক কারণ থাকলেও বেশীরভাগ মানুষ ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া কিংবা এলার্জির কারণে চোখ উঠা রোগে আক্রান্ত হয়।
ভাইরাস জনিত কারণে চোখ উঠলে করণীয়
ভাইরাসজনিত কারণে সবচেয়ে বেশী মানুষ চোখ উঠা রোগে আক্রান্ত হয়। যদি ভাইরাসের কারনে চোখ উঠে তাহলে দেখা যায় প্রথমে এক চোখ এই রোগ দ্বারা আক্রান্ত হয় এবং পরে অন্য চোখ আক্রান্ত হয়। আশে পাশের মানুষও এই রোগে আক্রান্ত হতে শুরু করে এবং চোখ দিয়ে পানি বের হয়ে থাকে।
উক্ত লক্ষণগুলো দেখলে ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা অধিক। এমন হলে নিজের ব্যবহৃত জিনিসপত্র অন্যের থেকে দূরে রাখায় শ্রেয়। প্রয়োজনে আইসোলেশনে যাওয়া যেতে পারে। ঘরোয়া উপায়ে ৭ দিন চিকিৎসা নিতে হবে। ৭ দিনের মধ্যে চোখ উঠার সমস্যা না কমলে ডাক্তারের কাছে যেতে হবে।
ব্যাকটেরিয়া জনিত কারণে চোখ উঠা
ব্যাকটেরিয়া জনিত কারণে চোখ উঠলে সেটি একই সাথে দুটি চোখই উঠে। ব্যাকটেরিয়া এর কারণে চোখ উঠলে সেটি অন্য চোখে কিংবা অন্য ব্যক্তিতে সংক্রমিত হবে না। চোখে পুঁজ জমা হওয়া ব্যাকটেরিয়া জনিত কারণে চোখ উঠার অন্যতম লক্ষণ। ব্যাকটেরিয়াজনিত কারণে চোখ উঠলে করণীয় কি চলুন তা জেনে আসি।
ব্যাকটেরিয়া জনিত কারণে চোখ উঠলে এই ধরনের সমস্যা ঘরোয়া উপায়েই সেরে নেওয়া যায়। তবে কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায় এই সমস্যা সারতে অনেক সময় নেয়। তখন ডাক্তারের কাছে যেতে হবে।
এলার্জি জনিত কারণে চোখ উঠলে করণীয়
এলার্জি জনিত কারণে চোখ উঠলে দুই চোখে একই সাথে উঠে থাকে। এলার্জি জনিত কারণে চোখ উঠলে তা অন্যদের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে না। এলার্জি জনিত কারণে চোখ উঠার অন্যতম লক্ষণ হচ্ছে চোখে চুলকানি হওয়া, চোখ দিয়ে পানি পড়া, চোখ ফুলে যাওয়া। এলার্জির অন্যান্য সমস্যা যেমন: চুলকানি, একজিমা কিংবা চর্মরোগের সাথে চোখ উঠার মতো রোগ হলে বুঝতে হবে এলার্জি জনিত কারণেই এমনটি হয়েছে।
এলার্জি জনিত কারণে চোখ উঠলে আগে এলার্জির ঔষধের দাম জেনে এলার্জির সমস্যা কমাতে হবে। তারপর চোখ উঠার জন্য ঘরোয়া পদ্ধতিতে সেবা নিতে হবে। এভাবে কিছুদিন চলার পরেও যদি সমস্যার সমাধান না হয় তাহলে ডাক্তারের কাছে যেতে হবে।
চোখ উঠার অন্যান্য কারন
চোখ উঠার অনেক কারণ রয়েছে। আমরা শুধুমাত্র কিছু কারন নিয়ে আলোচনা করেছি। তবে দেখা যায় এই কারণগুলোর জন্যই সবচেয়ে বেশী চোখ উঠে। তবে উক্ত কারণগুলো ছাড়াও চোখ উঠার আরও কারণ রয়েছে। সেগুলোর জন্যও চোখ উঠার মত সমস্যা হয়ে থাকে। চলুন জেনে নেওয়া যাক সে সমস্যা গুলো কি কি-
- রাসায়নিক পদার্থ চোখে প্রবেশ হওয়া।
- কনট্যাক্ট লেন্স বেশিক্ষণ ব্যবহার করা।
- বাইরের কোন পদার্থ কিংবা বস্তু চোখের ভীতরে প্রবেশ করা।
- যৌনবাহিত বিভিন্ন ধরনের রোগের সাথে চোখ উঠার সমস্যা হয়ে থাকে।
চোখ উঠলে যা করতে হবে
বেশীরভাগ সময়ই চোখ উঠলে ডাক্তারের কাছে যাওয়ার প্রয়োজন হয় না। বিশেষ কোন ধরনের চিকিৎসা না নিয়েও শুধুমাত্র ঘরোয়া উপায়ে চিকিৎসা নিয়েই চোখ উঠা সমস্যায় সুস্থ হওয়া সম্ভব। তবে কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায় ঘরোয়া উপায়ে চিকিৎসা নিয়েও সমস্যার সমাধান হয় না। তখন ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া ছাড়া উপায় থাকে না।
চোখ উঠার ঘরোয়া চিকিৎসা
অধিকাংশ সময়ই ঘরোয়া চিকিৎসার মাধ্যমেই চোখ উঠা সমাধান হয়ে যায়। যারা চানতে জান যে চোখ উঠলে করণীয় কি? তাদের বলবো আগে ঘরোয়া উপায়ে চিকিৎসা নিন। তাও যদি কোন কমার লক্ষণ না দেখে থাকেন তাহলে ডাক্তারের কাছে যান। তাই চলুন জেনে নেওয়া যাক চোখ উঠলে কি কি ঘরোয়া চিকিৎসা অবলম্বন করা যেতে পারে-
১. চোখ উঠলে অল্প ফ্লানেল এর কাপড় নিয়ে সেটি ঠাণ্ডা পানিতে ভিজিয়ে চোখে কিছুক্ষণ এর জন্য রাখা যেতে পারে। এতে চোখের জ্বালাপোড়া কমবে, চোখ ঠাণ্ডা রাখবে এবং আরাম পাবেন। এভাবে দিনে কয়েকবার করা যেতে পারে।
২. চোখ উঠলে চোখে পাতায় প্রচুর ময়লা জমা হয় সেই সাথে পুঁজও জমা হয়। সেগুলোও সবসময় পরিষ্কার রাখতে হবে। সেগুলো পরিষ্কার করার জন্য কিছুটা পানি নিয়ে গরম করতে হবে। তারপর সেই পানি ঠাণ্ডা করতে হবে। ঠাণ্ডা করে পানিতে অল্প কিছুটা সুতি কাপড় ভিজিয়ে চোখের উপরের ও নিচের অংশ পরিষ্কার করতে হবে। এগুলোতে প্রচুর ময়লা ও পুঁজ জমা হয়ে থাকে। সুতি কাপড়ের বদলে কটন প্যাড ব্যবহার করা যেতে পারে। চোখে ময়লা জমলেই এভাবে পরিষ্কার করতে হবে।
৩. যতদিন না সম্পূর্ণ রূপে সুস্থ হবেন ততদিন পর্যন্ত কোন ধরনের কোন ধরনের কনট্যাক্ট লেন্স ব্যবহার করা যাবে না।
৪. ভিটামিন সি খাওয়া। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করা।
৫. আইসোলেশনে থাকা
৬. পর্যাপ্ত বিশ্রাম নেওয়া
কখন ডাক্তারের কাছে যাবেন
ঘরোয়া চিকিৎসা নিতে থাকুন। ঘরোয়া চিকিৎসা নেওয়ার পরেও যদি এই লক্ষণগুলো দেখতে পান, তবে ঘরোয়া চিকিৎসা নেওয়ার পাশাপাশি ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। সেই লক্ষণগুলো হচ্ছে-
- ২ সপ্তাহের বেশী সময় ধরে চোখ উঠা সমস্যায় ভুগলে
- চোখ ভীষণ ব্যথা করলে, বেশী অসুস্থ হয়ে পড়লে
- আলোর দিকে তাকানো না গেলে
- দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে গেলে কিংবা কাঁপা কাঁপা দৃষ্টি হলে
- ২৮ দিনের কম বয়সী শিশুর চোখ উঠলে
সবশেষে যা জানা দরকার
চোখ কেন উঠে, চোখ উঠার কারন ও চোখ উঠলে করণীয় তার সবটাই আপনাদের সাথে আলোচনা করলাম। চোখ উঠা রোগে আতঙ্কিত না হয়ে ঘরে বসে ধৈর্য্য ধরে চিকিৎসা নিতে হবে। প্রথমে ঘরোয়া উপায়গুলো অনুযায়ী ঘরে চিকিৎসা নেওয়া। যদি দেখেন যে তাও সুস্থ হচ্ছেন না, তাহলে ডাক্তারের কাছে গিয়ে চিকিৎসা নিতে হবে। উপরোক্ত উপায়ে কাজ করলে ইনশাল্লাহ সুস্থতা লাভ করবেন।
Discussion about this post