ছোটবেলায় জ্বর ও সর্দি-কাশি হলে দাদি ও নানি’রা খাওয়াতেন তুলসী পাতার রস। কিছুদিনের মধ্যে আমাদের জ্বর, সর্দি-কাশি সেরেও যেতো। কি এমন আছে এই তুলসী পাতার রসে? এই তুলসী পাতা কি শুধু জ্বর-সর্দি সারাতে সক্ষম? তুলসী পাতার রস খাওয়ার উপকারিতা সমূহ কি কি? কীভাবে ব্যবহার করতে হয়? এগুলো সম্পর্কে আজকে আমরা বিস্তর আলোচনা করবো। সেই সাথে আমরা আপনাকে জানাবো তুলসী পাতা ব্যবহারের নিয়ম ও কিছু ক্ষেত্রে তুলসী পাতা ব্যবহারের অপকারিতা।
তুলসী পাতার রস খাওয়ার উপকারিতা
প্রকৃতিতে ঔষধি গাছের সংখ্যা অনেক। এসব গাছের অসংখ্য গুণাবলিও আছে। তার মধ্যে একটি গাছ হচ্ছে তুলসী গাছ। তুলসী পাতার মধ্যে এমন কিছু উপাদান বিদ্যমান যে উপাদানগুলোর মাধ্যমে শরীরের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান অনায়াসেই পাওয়া সম্ভব। তুলসি পাতার মাধ্যমে আমরা যেসব রোগ থেকে মুক্তি পেতে পারি তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে জ্বর, সর্দি-কাশি, পেটের সমস্যা, শরীর থেকে টক্সিন দূর করতে ও মাথা ব্যাথা কমাতে তুলসী পাতার অবদান ব্যাপক।
তুলসী পাতা শুধু শরীরের বিভিন্ন রোগ দূর করতে সাহায্য করে তা নয়। বরং এটি, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়, ত্বকের উন্নতি করে, ত্বক উজ্জল করে, কোলেস্টেরল কমাতে সাহায্য করে ও ক্ষতস্থান শুকাতে সাহায্য করে। চলো তুলসী পাতা ব্যবহারের নিয়মগুলো জেনে নেওয়া যাক-
১. পেটের সমস্যায়
পেটের বহুবিধ সমস্যায় তুলসী পাতার রস খাওয়ার উপকারিতা ব্যাপক। পেটের যেসব সমস্যায় তুলসী পাতা ব্যাপক ভূমিকা রাখে সেগুলো হচ্ছে পেটব্যাথা, গ্যাস, অ্যাসিডিটি/হাইপার অ্যাসিডিটি, আলসার, হজমজনিত সমস্যা ও অম্বল। পেটের সমস্যায় ২০০ মিলি পানিতে ৮-১০ টি তুলসী পাতা ভালো করে ফুটান। ততক্ষণ ফুটান যতক্ষণ না সেই পানিটি ১০০ মিলি হয়। অতঃপর, সেই পানি পান করুন। অথবা, ৮-১০ টি তুলসী পাতা চিবিয়ে খান। চিবিয়ে খাওয়ার পরিবর্তে আপনি তুলসী পাতার রসও খেতে পারেন।
২.জ্বর কমাতে তুলসী পাতা
তুলসী পাতা সবচেয়ে বেশী যে কাজে ব্যবহৃত হয় তা হচ্ছে জ্বর কমানো। জ্বর কমাতে চাইলে চা’য়ে ৫-৭ টি তুলসী পাতা ও দারুচিনি দিয়ে সিদ্ধ করে দৈনিক ২-৩ বার ৩ দিন খান। অথবা, প্রতিদিন সকালে ৮-১০ টি তুলসী পাতা খান।
৩. সর্দি-কাশি ও ঠান্ডা
বুকের মধ্যে জমে থাকা কফ উপশম করতে তুলসীর পাতার রসে দারুণ উপকার পাওয়া যায়। সর্দি-কাশি থেকে নিরাময় পেতে কয়েকটি তুলসী পাতা ও আদা দিয়ে চা বানানোর পরে মধু ও লেবু দিয়ে চা পান করুন।
৪. গলায় ব্যাথা হলে
গলায় ব্যাথা হলে ১০-১২ টি তুলসী পাতা পানির মধ্যে নিয়ে পানিটি ৮-১০ মিনিট ফুটানোর পরে সেই পানি ঠান্ডা করে দিনে ৩ বার গালগিল করুন। দু’দিনের মধ্যে আপনার ব্যাথা অনেকখানি কমে যাবে।
৫. ইনফ্লুয়েন্জা সারাতে তুলসী পাতার রস
ইনফ্লুয়েন্জা হলে ৮-১০ টা তুলসি পাতা/পাতার রস, এক চিমটি খাদ্য লবণ ও কিছু পরিমান লবঙ্গ নিয়ে একসাথে মিশিয়ে দিনে অন্তত দু’বার খান। এভাবে কিছুদিন খেলে আপনার সমস্যা অনেকাংশে কমে যাবে।
৬. রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দূর্বল হওয়ার কারণে প্রতিনিয়ত কোন না কোন রোগ লেগেই থাকে। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে চাইলে ১০-১২ টি তুলসি পাতা ২ কাপ পানিতে দিয়ে সেই পানি ফুটিয়ে ১ কাপ বানান। তারপর সেই পানি কুসুম কুসুম গরম থাকা অবস্থায় চায়ের মতো করে খান। কিছুদিন এভাবে ব্যবহার করলে আপনার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেকাংশে বেড়ে যাবে।
৭. কিডনি স্টোন
তুলসী পাতার রস খাওয়ার উপকারিতা তুলসী পাতায় থাকে অ্যাসিটিক অ্যাসিড যা কিডনি স্টোনকে ব্রেক ডাউন করতে সাহায্য করে। নিয়মিত কিছুদিন তুলসী পাতার রস ব্যবহার করলে সেই কিডনি স্টোনটি ইউরিনের সাহায্য বের হয়ে যায়।
৮. হার্ট এর সমস্যা
তুলসী পাতায় থাকে ম্যাগনেসিয়াম। যা শরীরের ধমনি গুলোকে প্রসারিত করে রক্তচাপ স্বাভাবিক করতে সাহায্য করে। সাথে কোলেস্টরল ও উচ্চ রক্তচাপ এর মতো সমস্যাও প্রশমিত করে। যা হার্টের রোগীদের জন্য খুবই উপকারী। হার্টের রোগী হলে নিয়মিত তুলসী পাতা খেতে পারেন।
৯. ভিন্ন প্রকার চোখের সমস্যা ও রাতকানা রোগ
শুষ্ক চোখ ও বিভিন্ন প্রকার চোখের ইনফেকশন রোধে তুলসী পাতা বিশেষ কার্যকরী। রাতকানা রোগে তুলসী পাতার রস খাওয়ার উপকারিতা বলে শেষ করা যাবে না। রাতকানা রোগ মূলত হয়ে থাকে ভিটামিন এ এর অভাবে। তুলসী পাতায় থাকে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন এ। নিয়মিত তুলসী পাতার রস খেলে চোখের ইনফেকশন ও রাতকানা এর মতো ভয়াবহ রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।
১০. মাথা ব্যাথা কমাতে
মাথা ব্যাথা কমাতে তুলসী পাতা ও আদা দিয়ে বানানো এক কাপ চা খেয়ে ফেলুন। অথবা, তুলসী পাতা ও চন্দন একসাথে বেটে কপালে প্রলেপ লাগিয়ে দিন। কিছুক্ষণ সময়ের মধ্যে মাথা ব্যাথা কমে যাবে।
১১. ডায়াবেটিস কন্ট্রোলে রাখতে
আপনারা কি জানেন তুলসী পাতা রক্তে গ্লুকোজের পরিমান নিয়ন্ত্রন করে। প্রতিদিন সকালে উঠে খেয়ে নিতে পারেন তুলসী পাতার বানানো এক কাপ চা। অথবা, রাতে পানির মধ্যে কয়েকটি তুলসী পাতা ভিজিয়ে সকালে সেই পানি পান করুন।
১২. শরীর থেকে টক্সিন দূর করতে
শরীর থেকে টক্সিন দূর করতে চাইলে ব্যবহার করতে পারেন তুলসী পাতার রস। প্রতিদিন সকালে ৩-৪ টি তুলসী পাতা খান। অথবা, তুলসী পাতার রস দিয়ে তৈরী করে নিতে পারেন এক কাপ সুস্বাদু চা।
১৩. ত্বক উজ্জল করে
ত্বক উজ্জল করতে ও বার্ধক্য প্রক্রিয়ার গতি কমাতে ব্যবহার করতে পারেন তুলসী পাতার রস। এক্ষেত্রে, চা বানানোর সময় চায়ের সাথে তুলসী পাতা দিয়ে ফুটিয়ে নেবেন। এভাবে দৈনিক কমপক্ষে এক কাপ চা পান করুন।
১৪. ক্ষতস্থান শুকাতে সাহায্য করে
কাটাছেঁড়ায় তুলসী পাতা অসাধারণ কার্যকর। যে কোন কাটাছেঁড়ায় ও ঘা শুকাতে সেই জায়গায় তুলসী পাতা বেটে লাগিয়ে দিন। এভাবে কিছুদিন ব্যবহার করলে সেই জায়গা অতি দ্রুত শুকিয়ে যাবে।
যেসব ব্যাক্তিদের তুলসী পাতা খাওয়া উচিত নয়
তুলসী পাতার রস খাওয়ার উপকারিতা বহু পরিমাণে হলেও এর কিছু সাইড ইফেক্ট ও আছে। তাই কিছু ব্যক্তিদের এটি কখনোই খাওয়া উচিত নয়। চলুন সেগুলো একটু জেনে আসা যাক-
১. ডায়াবেটিস ও হাইপোগ্লাইসেমিয়ার রোগী
আপনি যদি হাইপোগ্লাইসেমিয়ার রোগী হন এবং সাথে সুগারের ঔষধ খেয়ে থাকেন তাহলে তুলসী পাতা আপনার জন্য না খাওয়ায় ভালো। তাহলে রক্তে শর্করা কমে গিয়ে আপনার বড় ধরনের ক্ষতি হয়ে যেতে পারে।
২. গর্ভবতী ও স্তন পান করান যারা
গর্ভবতী মহিলা ও যেসব মহিলা স্তনপান করান তাদের জন্য তুলসী পাতা খাওয়া কখনোই উচিত হবে না। তুলসী পাতা খেলে আপনার শরীরে এমন কিছু সমস্যা হবে যা আপনার শরীরের জন্য মোটেও কাম্য নয়। তার মধ্যে পিরিয়ডের শুরু হয়ে যাওয়া ও স্তনে দুধের পরিমান অনেকাংশে কমে যাওয়া।
৩. নিম্ন রক্তচাপ
তুলসী পাতা শরীরে নিম্ন রক্তচাপ সৃষ্টি করে। তাই আপনার যদি নিম্ন রক্তচাপের সমস্যা থেকে থাকে তাহলে তুলসী পাতা আপনার জন্য মোটেও ফলদায়ক হবে না।
৪. রক্ত পাতলা করে
যে কোন সার্জারীর অন্তত ২০ দিন আগে তুলসী পাতা খাওয়া বন্ধ করুন। কারণ, তুলসী পাতা রক্ত পাতলা করে। পাতলা রক্ত জমাট বাধতে অধিক সময় নেয়। রক্ত বাধতে অধিক সময় নিলে সার্জারীর সময় অধিক রক্তপাত আপনার জন্য মোটেও উপকারী হবে না।
আরো জানুন: ১ মাসে চেহারা সুন্দর করার উপায়
শেষ কথা
কোনকিছুই অতিরিক্ত খাওয়া উচিৎ না। তুলসী পাতার রস খাওয়ার বহু উপকারিতা থাকলেও আপনি যদি তুলসী পাতা খেতেই থাকেন তাহলে সেটি আপনার জন্য উপকার না হয়ে বরং ক্ষতির কারণ হয়ে দাড়াবে। কিংবা, আপনি যদি একদিনে অনেকটা পরিমান তুলসী পাতা খেয়ে ফেলেন তাহলে তাও আপনার জন্য উপকারী না হয়ে বরং অপকারি হবে।
তুলসী পাতার রস খাওয়ার উপকারিতা নিয়ে এতক্ষণ আপনাদেরকে জানানো হলো। আশা করি ভালো লেগেছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও প্রযুক্তি বিষয়ক সবরকম টিপস পেতে যুক্ত থাকুন কোর্সটিকার সাথে। আমরা আছি ইউটিউবেও। আমাদের ইউটিউব চ্যানেলটি সাবস্ক্রাইব করুন এই লিংক থেকে।
Discussion about this post