দৈত্য ও জেলে : “এক জেলের চতুরতার গল্প” একটি পাঠ যা সাহস, বুদ্ধিমত্তা এবং চতুরতার উপরে ভিত্তি করে। এই গল্পে একজন গরিব জেলে তার দৈনন্দিন জীবন কাটাচ্ছিলেন নদীতে মাছ ধরে, কিন্তু একদিন সে একটি জাদুকরি জালা পায় যার মধ্যে বন্দি ছিল এক দৈত্য।
দৈত্যটি মুক্তির প্রতিশ্রুতি দেয়, কিন্তু শর্ত ছিল যে সে জেলেকে মৃত্যুদণ্ড দেবে। তবে জেলে তার বুদ্ধিমত্তা দিয়ে দৈত্যকে আবার জালায় বন্দি করে ফেলে। গল্পটি আমাদের শেখায় যে কঠিন পরিস্থিতিতেও বুদ্ধি এবং সাহস দিয়ে সমাধান বের করা সম্ভব।
দৈত্য ও জেলে
এক নদীর ধারে বাস করত এক গরিব জেলে। সে প্রতিদিন নদীতে পাঁচ বার করে জাল ফেলত। এতে যে মাছ পেত তা বেচেই তার সংসারের খরচ চালাত। কায়ক্লেশে দিন গুজরান হতো তার। একদিন সকালে জেলে এসে নদীতে জাল ফেলল।
প্রথম বার জাল টেনে দেখে একটিও মাছ পড়েনি জালে। জালে উঠল কেবল একটি মোটা গাছের গুঁড়ি। আবার জাল ফেলল সে। দ্বিতীয় বার জাল গুটিয়ে দেখল একটা মরা গাধা জালে জড়িয়ে রয়েছে।
জেলে আবার জাল ফেলল। তৃতীয় বারে জাল গুটিয়ে এনে দেখে বিরাট মাটির জালা। বিষণ্ণ মনে জালাটাকে জাল থেকে বের করে সে নদীর ধারে কাত করে রাখল। চতুর্থ বারে জালে উঠল
একগাদা ভাঙা হাঁড়ি-কলসি, আর ছোটোবড়ো কাচের টুকরো। দুঃখে হতাশায় জেলে এবার আকাশের দিকে মুখ করে বলল, খোদা, তোমার কী মর্জি জানি না। চার চার বার জাল ফেলে নসিবে কিছুই জুটল না। এবারই শেষ। তুমি দয়াময়, দেখ আমার ছেলেমেয়েদের যেন আজ অনাহারে না থাকতে হয়। এই বলে জেলে শেষবারের মতো জালটা পানিতে ছুঁড়ে মারল।
পঞ্চম ও শেষবার সে দেখল, একটা তামার জালা জালে আটকে আছে। জালাটার মুখ ঢাকনা দিয়ে আটকানো। তার উপরে কী যেন সব লেখা খোদাই করা রয়েছে। জেলে সামান্য লেখাপড়া জানত।
লেখাটা পড়ে দেখল ওটা দাউদের পুত্র সুলেমানের নাম। জেলের বুকে এবারে কিছুটা আশা ফিরে এল। সে ভাবল, এ যে দেখছি বাদশাহি জালা। নিশ্চয়ই মণিরত্ন কিছু রয়েছে ভেতরে। খোদার দয়ায় এবার বুঝি নসিব ফিরল।
জেলে নদীর পাড়ে পড়ে থাকা একখন্ড পাথর দিয়ে ঠুকে ঠুকে সাবধানে জালার ঢাকনাটা সরিয়ে ফেলল। ব্যাস, যেই না ঢাকনা সরে গেল অমনি গলগল করে রাশি রাশি ধোঁয়া বেরিয়ে আসতে লাগল ভেতর থেকে। দৈত্য ও জেলে জেলে চোখ বড়ো বড়ো করে ভয়ে একপাশে সরে দাঁড়াল। দেখতে দেখতে সেই ধোঁয়ার কুণ্ডলি একটা অতিকায় দৈত্যে পরিণত হলো।
দৈত্যের মাথাটা একটা বিশাল ঝুড়ির মতো। একগাছিও চুল নেই সেই মাথায়। আগুনের গোলার মতো ভয়ংকর দুটি চোখ আর মুখে শ্বেত পাথরের টুকরোর মতো দাঁত। দৈত্য বলল, সুলেমান ছাড়া আমি দুনিয়ার কাউকে পরোয়া করি না। কারণ আল্লাহর পয়গম্বর স্বয়ং সুলেমান।
একটু থেমে দৈত্য হাত জোড় করে আকাশের দিকে তাকিয়ে বিনীতভাবে বলল-মেহেরবান সুলেমান, দোহাই তোমার, আমাকে মেরে ফেলো না। আমি এক মুহূর্তের জন্যও আর তোমার কথার অবাধ্য হব না। যা হুকুম করবে, নত শিরে তাই তামিল করব।
জেলে দৈত্যের কথা শুনে ততক্ষণে কিছুটা সামলে নিয়েছে নিজেকে। সাহস করে বলল, হে দৈত্য, বাদশা সুলেমানের ভয়ে তুমি অমন কুঁকড়ে যাচ্ছ, সুলেমান তো আঠার শ বছর আগে এ দুনিয়ার মায়া কাটিয়ে বেহেশতে চলে গেছেন। তুমি কী এমন অন্যায় কাজ করেছিলে যার জন্য সুলেমান তোমাকে জালাটার মধ্যে পুরে রেখেছিলেন?
জেলের কথা শুনে দৈত্য হা-হা করে এমন জোরে হেসে উঠল যে, শব্দে জেলের কানে তালা লেগে যাবার অবস্থা হলো। হাসি থামিয়ে দৈত্য বলল, আল্লাহ ছাড়া আর কারো ওপরেই আমার সামান্যও আস্থা নেই। তাঁর কাছ থেকে তোমার জন্য জব্বর একটা খবর নিয়ে এসেছি।
জেলে সাহস করে জিজ্ঞেস করল, কী সে জব্বর খবর? তুমি দয়া করে আমাকে বল।
দৈত্য হাসতে হাসতে বলল, মৃত্যু। তোমার খবর। আর সেই মৃত্যু হবে এক ভয়ংকর উপায়ে।
মৃত্যুর কথা শুনে ভয়ে জেলের মুখ শুকিয়ে গেল। সে কাঁপতে কাঁপতে কোনো রকমে বলল, ভাই দৈত্য, আমি তো কোনো অন্যায় কাজ করিনি। তাহলে তুমি কেন আমাকে মারতে চাইছ? কতকাল তুমি এই জালাটার মধ্যে বন্দি হয়ে ছিলে।
নড়াচড়া করতে না পেরে কতই না কষ্ট পাচ্ছিলে। আমি তোমাকে মুক্তি দিয়েছি। এটাই যদি আমার অন্যায় হয়ে থাকে, আর তার জন্যই যদি আমাকে জান দিতে হয়, তবে আমার আর কিছুই বলার নেই।
দৈত্য যেন জেলের কথা শুনতেই পেল না। বলল, বল, তুমি নিজেই বল, কীভাবে মরতে চাও?
জেলে এবারে হাতজোড় করে বলল, মরতে আমার ভয় নেই, কিন্তু আমার অন্যায়টা কী তা বলবে তো? কেন তুমি আমাকে মারতে চাইছ?
দৈত্য এবারে বলল, তোমার গোস্তাকি কী, শুনবে? বদনসিব জেলে, তা হলে শোন বলছি। আমার নাম সক-হর-অল জিন। আমি বাদশাহ সুলেমানের গোলাম ছিলাম। আমার এমনই ক্ষমতা ছিল যে, দুনিয়ায় কাউকেই পরোয়া করতাম না। একদিন বাদশাহর হুকুম তামিল করতে অস্বীকার করে বসলাম।
এতে রেগে দিয়ে বাদশাহ শায়েস্তা করবার জন্য তার লোকজন দিয়ে আমাকে একটা তামার জালায় পুরে তার মুখ বন্ধ করে দিল। তারপর বাদশাহর মোহর খোদাই করে দিল জালাটার মুখে। আমি জালার ভেতরে বন্দি হয়ে গেলাম। বাদশাহ এরপর জালাটাকে নদীতে ফেলে দিল।
নদীর তলায় বন্দি অবস্থায় কাটতে লাগল আমার দিন। একদিন শপথ করলাম যদি চারশ বছরের মধ্যে কেউ আমাকে এ বন্দিদশা থেকে মুক্তি দেয়, তবে তাকে আমি অগাধ ধনরত্ন দিয়ে খুশি করব। দৈত্য ও জেলে কিন্তু আমার এমনই দুর্ভাগ্য যে, কেউ আমাকে মুক্তি দিল না।
নদীর তলায় এক এক করে চারশ বছর বহু কষ্টে কাটল আমার। তারপর আমি আবারও শপথ করলাম, যে আমাকে এই জালা থেকে উদ্ধার করবে, তাকে তিনটি বর দেব। যা সে চাইবে তা-ই পাবে। কিন্তু শয়ে শয়ে তিনশ বছর পার হল, কারো দেখা পেলাম না। এবারে আমার মেজাজ বিগড়ে গেল।
রাগে দুঃখে অপমানে শপথ করে বসলাম, আমাকে যে মুক্ত করবে সেই হতচ্ছাড়াকে আমি কতল করব। শতাব্দীর পর শতাব্দী গেল, কেউ উদ্ধার করতে এলো না। এভাবেই দিন কেটে যাচ্ছিল। কত বছর কাটল তার আর হিসেব রাখতে পারলাম না। ভাগ্যের ফলে এবারে তুমি এসে হাজির হলে। আমাকে মুক্তি দিলে। কিন্তু তুমি ডেকে আনলে নিজের মৃত্যু। শেষবারের মতো সুযোগ দিচ্ছি, তুমি নিজেই বেছে নাও কীভাবে মরতে চাও।
দৈত্যের কাহিনি শুনে জেলে বুঝতে পারল, আজ আর তার রক্ষা নেই।
মৃত্যুর ভয়ে ভীত হলেও জেলে বুদ্ধি হারাল না। হঠাৎ তার মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। সে বলল, ভাই, আমি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছি না যে, তোমার অত বড় শরীরটা কেমন করে এই জালার মধ্যে ছিল।
সত্য বলছ কি মিথ্যা বলছ, তা তুমিই জান। কিন্তু আমি হলপ করে বলতে পারি তোমাকে দেখলে এ কথা কেউই বিশ্বাস করবে না।
জেলের কথা শুনে দৈত্য দাঁত কড়মড় করে মেঘের গর্জন তুলে বলল, কী! আমি মিথ্যা কথা বলছি? এই জালার মধ্যে আমি থাকতে পারি না? বেশ, মরার আগে জেনে যাও, দৈত্য মিথ্যা কথা বলে না।
কথাগুলো বলে অহংকারী দৈত্য চোখের পলকে ধোঁয়ার কুণ্ডলি পাকিয়ে জালাটার ভেতরে ঢুকে গেল। আর যেই না ভেতরে ঢোকা, অমনি জেলে এক লাফে এসে জালাটার মুখে ঢাকনা লাগিয়ে দিল।
তারপর হাসতে হাসতে চিৎকার করে বলল, বেইমান দৈত্য, এবার নিজেকে রক্ষা কর। তোর প্রতিজ্ঞা নিয়ে আবার শতাব্দীর পর শতাব্দী জলে ডুবে থাক। দেখব, এবারে কে তোকে রক্ষা করে। এই বলে জেলে জালাটাকে আবার নদীতে ফেলে দিল।
এই অধ্যায়ের অনুশীলনীমূলক কাজ
১. জেনে নিই।
কল্পকাহিনি ‘আলিফ লায়লা’ আরবীয় গল্প হলেও কাহিনিগুলোর আবেদন সর্বজনীন। ১০০১টি কাহিনিভিত্তিক আরব্যরজনীর গল্প লোকের মুখে মুখে ফিরত। এগুলোর অধিকাংশই সংগৃহীত হয়েছে বাগদাদের খলিফা হারুন অর রশীদের আমলে। এই লোককথাগুলো এক হাতে, একসময়ে, এমনকি এক দেশে লেখা হয়নি।
প্রাচীন পারসিক ভাষায় হাজার আফসানা বা হাজার গল্প নামে এই গল্পগুলো প্রথম লিখিত রূপ পেয়েছিল। মোঘল আমলে এ কাহিনিগুলো মধ্যপ্রাচ্য থেকে এ দেশে এসেছে। গল্পগুলো এখন বিশ্বসাহিত্য জগতের সম্পদ।
২. নিচের শব্দগুলোর অর্থ জেনে নিই, বাক্য লিখি
জেলে — মৎস্য শিকারী। — জেলেরা মাছ বেচে সংসার চালায়।
কায়ক্লেশে — শারীরিক পরিশ্রম করে। — শ্রমিকরা কায়ক্লেশে জীবনযাপন করে।
গুজরান — অতিবাহিত করা, যাপন। — সে খুব কষ্টে দিন গুজরান করে।
মর্জি — ইচ্ছা, সম্মতি। — মর্জি হলে এখন তুমি গান গাইতে পার।
জালা — বিরাট মাটির পাত্র বিশেষ। — জালার মধ্যে দৈত্যটি বন্দি ছিল।
অনাহার — উপবাস, না খেয়ে থাকা। — গরিব লোকটি কোনো কোনো দিন অনাহারে কাটায়।
গোস্তাকি — অপরাধ, অনিয়ম। — শিক্ষক বললেন, ‘তুমি গোল্ডাকি করেছ, মাফ চাও’।
নসিব — ভাগ্য, অদৃষ্ট। — আমার নসিব ভালো।
বদনসিব — মন্দ ভাগ্য। — বদনসিব ছেলেটির পরীক্ষার আগের রাতে জ্বর হলো।
শ্বেত — সাদা, ধবল। — তাজমহল শ্বেত পাথর দ্বারা নির্মিত।
আস্থা — ভরসা, বিশ্বাস। — রহিমের ওপর সকলের আস্থা আছে।
জব্বর — দারুণ। — তোমাকে একটি জব্বর খবর দেব।
বেইমান — অকৃতজ্ঞ, বিশ্বাসঘাতক। — সবাই বেইমানকে ঘৃণা করে।
প্রতিজ্ঞা — শপথ, অঙ্গীকার। — সবার উপকার করব- এ আমার প্রতিজ্ঞা।
মোহর — স্বর্ণমুদ্রা, এখানে সিল বা নামের ছাপ। — পরীক্ষার উত্তরপত্রগুলো মোহর করে দাও।
৩. শূন্যস্থান পূরণ করি।
ক. সে প্রতিদিন নদীতে _______ করে জাল ফেলত।
খ. বলতে বলতে জেলে _______ বারের মতো জালটা _______ ছুঁড়ে মারল।
গ. তোমার জন্য _______ একটা খবর নিয়ে এসেছি।
ঘ. কেন তুমি আমাকে _______ চাইছ?
ঙ. দৈত্য এবার বলল, তোমার _______ কী শুনবে?
৪. ডান দিক থেকে শব্দ বেছে নিয়ে বাম দিকের শব্দের সঙ্গে মেলাই।
গরিব | জেলে |
মাটির | দাঁত |
কাচের | খবর |
কুণ্ডলি | লোকজন |
জব্বর | বিগড়ে |
বাদশাহর | জালা |
কড়মড় | পাকিয়ে |
মেজাজ | টুকরো |
৫. নিচের শব্দগুলোর উচ্চারণ ও বানান জেনে নিই।
কায়ক্লেশে, কসরত, ব্যর্থ, বিষণ্ণ, দীর্ঘশ্বাস, বিস্ফারিত, কুণ্ডলি, ভয়ংকর, আস্থা, আতঙ্ক, বিদ্রোহী, বিশ্বস্ত।
৬. নিচের প্রশ্নগুলোর উত্তর বলি ও লিখি।
ক. জেলের সংসার কীভাবে চলত?
খ. জালা দেখে জেলে কী ভাবল?
গ. জালা থেকে কী বের হয়ে আসল?
ঘ. দৈত্যটি দেখতে কেমন ছিল?
ঙ. বাদশাহ কেন দৈত্যকে বন্দি করেছিলেন?
চ. দৈত্য কেন জেলেকে মারতে চেয়েছিল?
ছ. জেলে কেমন করে দৈত্যের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করল?
৭. গল্পটি পড়ে কী শিখলাম, তা লিখি।
◉ আরও দেখুন: পঞ্চম শ্রেণির বাংলা বইয়ের সকল গল্প-কবিতার সমাধান
শিক্ষার্থীরা, উপরে তোমাদের বাংলা মূল বই থেকে দৈত্য ও জেলে গল্পটি আলোচনা করা হয়েছে। এই অধ্যায়ের অনুশীলনীমূলক কাজগুলোর সমাধান পেতে উপরের উত্তরমালা অপশনে ক্লিক করো। এছাড়াও তোমাদের পরীক্ষা প্রস্তুতির জন্য অতিরিক্ত বেশকিছু প্রশ্ন দেওয়া হয়েছে। এ প্রশ্নগুলো খুব ভালোভাবে অনুশীলন করার পরামর্শ থাকবে।
Discussion about this post