পাঠান মুলুকে সৈয়দ মুজতবা আলী : এই অংশটি একটি ভ্রমণকাহিনীর অংশ, যেখানে লেখক পেশাওয়ার পৌঁছানোর অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন। গল্পের মাধ্যমে পাঠানের আতিথেয়তা, তাদের স্বাধীনচেতা মনোভাব এবং জীবনযাপনের ধরণ প্রকাশ পেয়েছে।
লেখক শেখ আহমদ আলীর উষ্ণ অভ্যর্থনার বর্ণনা দিয়েছেন, যা পাঠানের আন্তরিকতার পরিচায়ক। পাশাপাশি, পাঠানদের রাস্তা ব্যবহারের স্বাধীনতা ও তাদের নির্লিপ্ত দৃষ্টিভঙ্গিও ফুটে উঠেছে। এই লেখায় পেশাওয়ারের সংস্কৃতি, মানুষের আচার-আচরণ এবং পরিবেশের প্রতি লেখকের কৌতূহল ও পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা স্পষ্টভাবে প্রকাশিত হয়েছে। এটি পাঠকদেরকে এক ভিন্ন সংস্কৃতি সম্পর্কে জানার সুযোগ করে দেয়।
পাঠান মুলুকে সৈয়দ মুজতবা আলী
১৯০৪ সালের ১৩ই সেপ্টেম্বর সৈয়দ মুজতবা আলী আসামের কাছাড় জেলার করিমগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বিশ্বভারতী থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। পরে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেন।
১৯২৭ সালে তিনি আফগানিস্তানের শিক্ষা বিভাগের অধীনে কাবুল কৃষিবিজ্ঞান কলেজে ইংরেজি ও জার্মান ভাষার অধ্যাপক নিযুক্ত হন। কাবুল প্রবাসের বিচিত্র অভিজ্ঞতা বর্ণিত হয়েছে তাঁর ‘দেশে বিদেশে’ গ্রন্থে। ১৯৭৪ সালে ১১ই ফেব্রুয়ারি তিনি ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।
পাঠান মুলুকে গল্পের শুরু এখানে
সর্দারজি চুল বাঁধতে, দাড়ি সাজাতে আর পাগড়ি পাকাতে আরম্ভ করলেন। তখনই বুঝতে পারলুম যে পেশাওয়ার পৌঁছতে আর মাত্র ঘণ্টাখানেক বাকি। গরমে, ধুলোয়, কয়লার গুঁড়োয়, কাবাব-রুটিতে আর স্নানাভাবে আমার গায়ে একরত্তি শক্তি নেই। বিছানা গুটিয়ে হোল্ডল বন্ধ করতেও পারছিলাম না। কিন্তু পাঠানের সঙ্গে ভ্রমণ করাতে সুখ আছে। আমাদের কাছে যেটা কঠিন বলে বোধ হয় পাঠান সেটা গায়ে পড়ে করে দেয়।
ইতোমধ্যে গল্পে গল্পে জেনে গেছি পাঠান-মুলুকের প্রবাদ। দিনের বেলা পেশাওয়ার ইংরেজের, রাত্রে পাঠানের। গাড়ি পেশাওয়ার পৌঁছবে রাত নয়টায়। তখন যে কার রাজত্বে পৌঁছব তাই নিয়ে মনে মনে নানা ভাবনা ভাবছি, এমন সময় দেখি গাড়ি এসে পেশাওয়ারেই দাঁড়াল। বাইরে ঠা-ঠা আলো, নয়টা বাজল কী করে, আর পেশাওয়ারে পৌছুলাম বা কী করে? এখন চেয়ে দেখি সত্যি নয়টা বেজেছে।
প্ল্যাটফরমে বেশি ভিড় নেই। জিনিসপত্র নামাবার ফাঁকে লক্ষ করলুম ছয় ফুটি পাঠানের চেয়েও একমাথা উঁচু এক ভদ্রলোক আমার দিকে এগিয়ে আসছেন। তিনি এসে উত্তম উর্দুতে আমাকে বললেন, তাঁর নাম শেখ আহমদ আলী। আমি নিজের নাম বলে একহাত এগিয়ে দিলাম।
তিনি তাঁর দুহাতে সেটি লুফে নিয়ে দিলেন এক চাপ পরম উৎসাহে, গরম সংবর্ধনায়! হঠাৎ আমাকে দুহাত দিয়ে জড়িয়ে খাস পাঠানি কায়দায় আলিঙ্গন করতে আরম্ভ করলেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি উর্দু পশুতে মিলিয়ে অনেক কথা বলছিলেন। তার অনুবাদ “ভালো আছেন তো, মঙ্গল তো, সব ঠিক তো, বেজায় ক্লান্ত হয়ে পড়েননি তো?” আমি ‘জি হাঁ, জি না’ করেই যাচ্ছি।
আর ভাবছি গাড়িতে পাঠানদের কাছ থেকে তাদের আদবকায়দা কিছুটা শিখে নিলে ভালো করতাম। খানিকটা কোলে-পিঠে, খানিকটা টেনে-হিঁচড়ে তিনি আমাকে স্টেশনের বাইরে এনে একটা টাঙ্গায় বসালেন। আমি তখন শুধু ভাবছি ভদ্রলোক আমাকে চেনেন না জানেন না। আমি বাঙালি তিনি পাঠান। তবে যে এত সংবর্ধনা করছেন তার মানে কী? এর কতটা আন্তরিক, আর কতটা লৌকিকতা?
আজ বলতে পারি পাঠানের অভ্যর্থনা সম্পূর্ণ নির্জলা আন্তরিক। অতিথিকে বাড়িতে ডেকে নেওয়ার মতো আনন্দ পাঠান অন্য কোনো জিনিসে পায় না। আর সে অতিথি যদি বিদেশি হয় তাহলে তো কথাই নেই।
টাঙ্গা তো চলছে পাঠানি কায়দায়। আমাদের দেশে সাধারণত লোকজন রাস্তা সাফ করে দেয় গাড়ি সোজা চলে। পাঠানমুলুকে লোকজন যার যে রকম খুশি চলে। গাড়ি এঁকে-বেঁকে রাস্তা করে নেয়। ঘণ্টা বাজানো, চিৎকার বৃথা। খাস পাঠান কখনো কারো জন্যে রাস্তা ছেড়ে দেয় না।
সে স্বাধীন, রাস্তা ছেড়ে দিতে হলে তার স্বাধীনতা রইল কোথায়? কিন্তু ওই স্বাধীনতার দাম দিতেও সে কসুর করে না। ধরা যাক, ঘোড়ার নালের চাট লেগে তার পায়ের এক খাবলা মাংস উড়ে গেল। এতে সে রেগে গালাগালি, মারামারি বা পুলিশে ডাকাডাকি করে না। পরম শ্রদ্ধায় ও বিরক্তি সহকারে ঘাড় বাঁকিয়ে শুধু জিজ্ঞাসা করে, দেখতে পাস না? গাড়োয়ানও স্বাধীন পাঠান ততোধিক অবজ্ঞা প্রকাশ করে বলে, ‘তোর চোখ নেই?’ ব্যস্। যে যার পথে চলল।
এই অধ্যায়ের অনুশীলনীমূলক কাজ
১. শব্দগুলো পাঠ থেকে খুঁজে বের করি। অর্থ বলি।
স্নানাভাবে, একরত্তি, হোল্ডল, ঠা-ঠা আলো, আলিঙ্গন করা, অভ্যর্থনা, নির্জলা, বৃথা খাস, ঘোড়ার নালের চাট, অবজ্ঞা, টাঙ্গা, কসুর, প্ল্যাটফরম
২. ঘরের ভিতরের শব্দগুলো খালি জায়গায় বসিয়ে বাক্য তৈরি করি।
বৃথা, আলিজ্ঞান, অভ্যর্থনা, একরত্তি, ঠা-ঠা আলো
ক. আমার চোখে _______ ঘুম নেই।
খ. এত _______ চোখ মেলে তাকানো যায় না।
গ. ঈদের সময় আমরা সবাই _______ করে থাকি।
ঘ. তাদের _______ অনেক ভালো ছিল।
ঙ. _______ সময় নষ্ট করা ঠিক নয়।
৩. প্রশ্নগুলোর উত্তর বলি ও লিখি।
ক. সর্দারজিকে চেনা যায় কী দেখে?
খ. দিনের বেলায় ও রাত্রে পেশাওয়ার শহরে কী হয়?
গ. পাঠানদের অভ্যর্থনা কেমন হয়ে থাকে এবং কেন?
ঘ. পাঠানেরা কীভাবে টাঙ্গা চালায়?
৪. ক্রিয়াপদের বিভিন্ন রূপ রয়েছে। যেমন- মূল ক্রিয়াপদ যাওয়া। এই ক্রিয়াপদটি থেকে অনেক শব্দ হতে পারে। যেমন-
যাই – আমি বাড়ি যাই।
যাব – আমি বিকেলে খেলা দেখতে যাব।
গিয়েছি – আমি ওখানে গতকালও গিয়েছি।
যেতাম – ছোটবেলায় আমি প্রায়ই মামাবাড়ি যেতাম।
এখন নিচের ক্রিয়াপদগুলো দিয়ে একইরকম ভাবে শব্দ ও বাক্য লিখি।
আসা, খাওয়া, করা
৫. বাক্য রচনা করি।
ভ্রমণ, পেশাওয়ার, ঠা-ঠা আলো, সংবর্ধনা, ডাকাডাকি, অবজ্ঞা
৬. বিপরীত শব্দ লিখি এবং তা দিয়ে একটি করে বাক্য লিখি।
আরম্ভ – শেষ – আজ আমার পরীক্ষা শেষ হলো।
গরম – ঠান্ডা – শীতকালে প্রচুর ঠান্ডা লাগে।
কঠিন
ভিতর
দিন
দাঁড়ানো
আলো
উঁচু
৭. কর্ম-অনুশীলন।
নিজে বেড়িয়ে এসেছি এরকম একটা জায়গা সম্পর্কে বলি।
◉ আরও দেখুন: চতুর্থ শ্রেণির বাংলা বইয়ের সকল গল্প-কবিতার সমাধান
শিক্ষার্থীরা, উপরে তোমাদের বাংলা মূল বই থেকে পাঠান মুলুকে সৈয়দ মুজতবা আলী গল্পটি আলোচনা করা হয়েছে। এই অধ্যায়ের অনুশীলনীমূলক কাজগুলোর সমাধান পেতে উপরের উত্তরমালা অপশনে ক্লিক করো। এছাড়াও তোমাদের পরীক্ষা প্রস্তুতির জন্য অতিরিক্ত বেশকিছু প্রশ্ন দেওয়া হয়েছে। এ প্রশ্নগুলো খুব ভালোভাবে অনুশীলন করার পরামর্শ থাকবে।
Discussion about this post