আজকের আধুনিক সভ্যতা যে উচ্চ পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে এর পেছনে আছে বিজ্ঞানের অবদান। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মানুষের জীবনকে সহজ থেকে সহজতর করে তুলছে। আর আধুনিক বিজ্ঞানেরই অন্যতম অবদান মােবাইল ফোন। বর্তমানে ফোন ব্যবহার করে না এমন মানুষ নেই বললেই চলে।
আজকাল মানুষ তার সকল তথ্য মোবাইল ফোনে রাখতেই বেশি পছন্দ করে। তবে তথ্য সংরক্ষণের জন্য মোবাইল কতটুকু নিরাপদ? একদল অসাধু লোকের তৈরি স্পাইওয়্যার জেনে নিতে পারে আপনার সকল তথ্য।
ইসরায়েলের হারজিলিয়া শহরে যাত্রা শুরু হয় এনএসও গ্রুপের। তিন বন্ধু নিভ কারমি, শালেভ হুলিও এবং ওমরি লাভিয়ে মিলে এনএসও প্রতিষ্ঠা করেন। তিনজনের নামের প্রথম অক্ষর দিয়ে এনএসও নামের উদ্ভব।
আর পেগাসাস হলো এই ইসরায়েলি সাইবার আর্মস সংস্থা এনএসও গ্রুপ দ্বারা নির্মিত একটি স্পাইওয়্যার যা গোপনে মোবাইল ফোনে আড়িপাতার যন্ত্র হিসেবে কাজ করে। এনএসও প্রথমে নজরদারি ভিত্তিক সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে যাত্রা শুরু করলেও পরে গোপনে আড়িপাতার যন্ত্র হিসেবে অন্ধকার রাস্তাটি বেছে নেয়।
বিশ্বজুড়ে মানবাধিকারকর্মী, সাংবাদিক, আইনজীবী, রাজনৈতিক নেতাদের ফোনে নজরদারি চালানোর ঘটনা ফাঁস হওয়ার পর এই পেগাসাস নিয়ে বিশ্বজুড়ে আলোচনা শুরু হয়।
ব্রিটিশ দৈনিক গার্ডিয়ানসহ ১৬ টি সংবাদপত্রের অনুসন্ধানের মধ্য দিয়েই পেগাসাস কেলেঙ্কারি প্রকাশ্যে এসেছে। ইসরায়েলি কোম্পানি এনএসও গ্রুপ বিভিন্ন দেশের সরকারের কাছে পেগাসাস নামের এই ‘হ্যাকিং সফটওয়্যার’ বা ‘স্পাইওয়্যারটি’ বিক্রি করছে। যার মাধ্যমে নিজের দেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের ওপর নজরদারি চালিয়ে আসছে ‘কর্তৃত্ববাদী’ সরকারগুলো।
এখন আসা যাক এই পেগাসাস কি কি করতে পারে। আইওএস বা অ্যান্ড্রয়েডে চলে এমন শত কোটি ফোনে নজরদারি চালানোর ক্ষমতা এই পেগাসাস সিস্টেমের রয়েছে। পেগাসাস যদি একবার আপনার ফোনে ঢোকার পথ করে নিতে পারে, তাহলে আপনার অগোচরে সে আপনার ফোনকে পরিণত করবে ২৪ ঘণ্টার এক নজরদারির যন্ত্রে।
আপনার ফোনে যে কোন মেসেজ বা ছবি আসলে তা কপি করে তৃতীয় পক্ষের কাছে পাচার করে দিতে পারে। এই সফটওয়্যার গোপনে আপনার ফোনের মাইক্রোফোন ব্যবহার করতে পারে। এতে করে সেই সফটওয়্যার ফোন কল রেকর্ডসহ আপনি কার সাথে কি আলোচনা করছেন তাও জেনে নিতে পারে।
এমনকি ফোনের ক্যামেরা ব্যবহার করে গোপনে আপনার ভিডিও ধারণ করতে পারে। আপনি কোথায় আছেন, কিংবা কোথায় গিয়েছিলেন, কার সাথে দেখা করেছিলেন, সেসব বিষয়ও পেগাসাস চিহ্নিত করার ক্ষমতা রাখে। আর একবার ফোনে ঢুকে পড়তে পারলে এই স্পাইওয়্যার প্রায় সব ধরনের ফাইলই কব্জা করার সুযোগ পায়।
এসএমএস, অ্যাড্রেস বুক, কল হিস্ট্রি, ইমেইল এবং ইন্টারনেটের ব্রাউজিং হিস্ট্রি – সবই সে দেখাতে পারে। এমনকি ফোনের মালিক যা করতে পারেন, পেগাসাস তখন তার চেয়েও বেশি কিছু করতে পারে। তাহলে বুঝতেই পারছেন কতটা ভয়ঙ্কর এই পেগাসাস স্পাইওয়্যার।
২০১৬ সালে গবেষকরা পেগাসাসের প্রথম উপস্থিতির কথা জানতে পারে। সেসময় কোন নির্দিষ্ট এক ব্যক্তির ফোনে মেইল বা মেসেজের মাধ্যমে পাঠানো হতো লিংক। আর সেই লিঙ্কে ক্লিক করলেই ফোনে ইন্সটল হয়ে যেত পেগাসাস।
তবে অতীতের তুলনায় বর্তমানে পেগাসাস তাদের নজরদারিতে আরও কয়েক গুণ উন্নতি নিয়ে এসেছে। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ব্যাপার হল এখন কোনো ক্লিক না করেও ফোনে ইন্সটল হয়ে যেতে পারে পেগাসাস সফটওয়্যার। যেকোনো সফটওয়্যারের ত্রুটি বা বাগ ব্যবহার করেও এ স্পাইওয়্যার ঢুকে পড়তে পারে ফোনে, যে ত্রুটির কথা হয়ত ফোন উৎপাদকরা জানেই না।
আবার হোয়াটসঅ্যাপে কোন নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে ভয়েস কল দেয়ার মাধ্যমে তার ফোনে পেগাসাস সফটওয়্যার ইন্সটল করানো যায়। ২০১৯ সালে হোয়াটসঅ্যাপ জানায় তাদের সফটওয়্যার ত্রুটির সুযোগ নিয়ে এনএসওর সফটওয়্যার ১৪০০ ফোনে ম্যালওয়ার পাঠিয়েছিল।
শুধু অ্যান্ড্রয়েডেই নয়, আইফোনের আইমেসেজ সফটওয়্যারের ত্রুটি ব্যবহার করে পেগাসাস আইফোনেও প্রবেশ করতে সক্ষম হচ্ছে। অ্যাপল কোম্পানি জানায় তারা এই হ্যাকিং সিস্টেম রোধ করতে সবসময় তাদের সফটওয়্যার আপডেট করে যাচ্ছে।
তবে পেগাসাস দিনে দিনে তার উন্নতি করে অসৎ কাজের ক্ষমতা বাড়িয়েই চলেছে। এই পেগাসাস সফটওয়্যার এতটাই উন্নত যে কোন এন্ড্রয়েড বা অ্যাপল ডিভাইসে এর উপস্থিতি নির্ণয় করা খুব মুশকিল। এতে করে এই সফটওয়্যার আরো ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে।
এখন অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগতে পারে যে কীভাবে এই স্পাইওয়্যার থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। মূলত পেগাসাস সফটওয়্যার ডিজাইন করা হয়েছে গভমেন্ট এর জন্য। এটি অনেক দামি একটি সফটওয়্যার। সুতরাং কোনো গভমেন্ট ছাড়া এই সফটওয়্যার কোন সাধারন জনগণ কিনতে পারবে না। আর গভমেন্ট এই সফটওয়্যার কোন সাধারণ জনগণের ওপর নজরদারির জন্য ব্যবহার করে না।
দ্য গার্ডিয়ানসহ আরো ১৬ টি গণমাধ্যমে পেগাসাস সফটওয়ারের নজরদারির তালিকা প্রকাশ পেয়েছে। এই তালিকার মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান, বড় বড় ব্যবসায়ী, মানবাধিকারকর্মী এবং সাংবাদিকসহ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। এখানে আপনার আমার মত সাধারণ জনগণের পেগাসাসের সম্মুখীন হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।
যেহেতু এটি অনেক শক্তিশালী একটি সফটওয়্যার। আর এই সফটওয়্যার এর উপস্থিতি আপনার ফোনে আছে কিনা তা নির্ণয় করাই অসম্ভব, সেখানে এর থেকে মুক্তি পাওয়া অনেকটা কঠিন ব্যাপার।
অ্যামনেস্টি সিকিউরিটি ল্যাবের গবেষক ক্লডিও গুয়ারনিয়েরি বলেন, “যখনই আমরা কোনো ফোনের ফরেনসিক পরীক্ষা করি, প্রায় প্রতি ক্ষেত্রেই একটি প্রশ্ন আমাদের শুনতে হয়- কী করলে ভবিষ্যতে আবারও এরকম হ্যাকিং ঠেকানো যাবে। সত্যি কথা বলতে, এর কোনো উপায় নেই।”
একবার পেগাসাস দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার পর ফোনের সিম কার্ড ভেঙে ফেলা, মোবাইল পরিবর্তন করা, নাম্বার পরিবর্তন করার মত কাজ করলেও আবার পেগাসিস দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
তবে আপনি যদি স্মার্টফোন ব্যবহার করা বন্ধ করে দেন তখন আপনি পেগাসাসের হাত থেকে রক্ষা পেতে পারেন, যা কিনা নিতান্তই অসম্ভব একটি ব্যাপার। এছাড়া অপরিচিত কোন লিংকে ক্লিক না করার মাধ্যমে এর ঝুঁকি কমানো যায়। হোয়াটসঅ্যাপের আননোন কল রিসিভ না করার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। বিভিন্ন দেশের গবেষকরা এই পেগাসাস সফটওয়্যার রোধে বিভিন্ন কাজ করছে।
পেগাসাস স্পাইওয়্যার সম্পর্কে আরো বিস্তারিত জানতে নিচের ভিডিওটি দেখুন।
Discussion about this post