প্রবাস জীবন শুধুমাত্র একটি ভৌগোলিক স্থানান্তর নয়; এটি আবেগ, ত্যাগ, এবং নতুন পরিবেশে খাপ খাওয়ানোর এক গভীর গল্প। যারা দেশ ছেড়ে প্রবাসে পাড়ি জমান, তাদের জন্য এই যাত্রা যতটা স্বপ্নপূরণের, ততটাই কষ্টের। প্রবাস জীবন নিয়ে কিছু কথা বলতে চাই আজ, যা আমাদের লক্ষ রেমিটেন্স যোদ্ধাদের মনের কথা। প্রবাসীদের জীবনে নানা রকম আবেগ মিশে থাকে—দেশের জন্য টান, প্রিয়জনদের জন্য মায়া এবং নিজের শিকড়ের প্রতি ভালোবাসা। আসুন, প্রবাস জীবন নিয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক আলোচনা করা যাক।
প্রবাস জীবন নিয়ে কিছু কথা
দেশ ছেড়ে প্রবাসে যাওয়া যে কতটা কষ্টদায়ক, তা কেবল একজন প্রবাসীই অনুভব করতে পারেন। জীবিকার তাগিদে নিজের মাতৃভূমি, পরিচিত পরিবেশ, এবং চেনা মানুষদের ছেড়ে অজানা এক দেশে নতুনভাবে শুরু করার সিদ্ধান্ত নেওয়া মোটেই সহজ নয়। দেশের মাটি, নদী, গাছপালা, এবং গ্রামীণ জীবনের যে সৌন্দর্য, তা ছেড়ে যাওয়ার যন্ত্রণা প্রতিদিন প্রবাসীদের হৃদয়ে বাজতে থাকে। আর দেশের জন্য প্রাণ কাঁদতে থাকে। সর্বক্ষণ মনে হতে থাকে—কখন দেশে ফিরব? কখন প্রিয় মাতৃভূমির মুখ দেখব।
প্রিয়জন ছেড়ে থাকার কষ্ট
প্রবাস জীবন মানেই প্রিয়জনদের থেকে দূরে থাকা। মা-বাবা, ভাই-বোন, এবং আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে কাটানো মুহূর্তগুলো প্রবাসীদের জন্য সবচেয়ে মূল্যবান স্মৃতি হয়ে থাকে। বছরের পর বছর দূরে থাকা এবং শুধুমাত্র ফোনকল কিংবা ভিডিও কলে তাদের সঙ্গে কথা বলা অনেক সময় পর্যাপ্ত মনে হয় না। ঈদ আসে, ঈদ যায়, বাবার সাথে ঈদের নামাজ পড়া হয় না। পরিবার ছাড়া উৎসব উদযাপনও মলিন মনে হয়। মনে হয়, সবকিছু আছে—কিন্তু কিছু একটা নেই।
প্রিয় মাতৃভূমি ছেড়ে থাকার কষ্ট
প্রবাসীদের কাছে তাদের মাতৃভূমি একটি আবেগের নাম। বিদেশের উন্নত সুযোগ-সুবিধা থাকা সত্ত্বেও, বাংলাদেশের মাটি, সংস্কৃতি, এবং পরিবেশের প্রতি ভালোবাসা কখনো কমে না। দেশের ভাষা, ঐতিহ্য, এবং দৈনন্দিন জীবনের সরলতা থেকে দূরে থাকা প্রবাসীদের জন্য বড় এক ধরনের অভাববোধ তৈরি করে। প্রবাসীদের মনের মধ্যে তাদের মাতৃভূমির প্রতি যে গভীর ভালোবাসা জন্মায় তা সহজেই বোঝা যায়। বিদেশের উন্নত জীবনযাত্রা সত্ত্বেও, তারা নিজের দেশের মাটি, মানুষ, সংস্কৃতি এবং পরিবেশের প্রতি যে আকর্ষণ অনুভব করে তা অন্য কোথাও পাওয়া যায় না।
প্রবাসীদের এই ভালোবাসা দেশের জন্য একটি মূল্যবান সম্পদ। সার্বিকভাবে বলতে গেলে, প্রবাসীদের মাতৃভূমির প্রতি ভালোবাসা একটি সুন্দর ও প্রশংসনীয় বিষয়। এই ভালোবাসা দেশের জন্য একটি মূল্যবান সম্পদ।
মায়ের হাতের খাবার না খাওয়ার কষ্ট
প্রবাসে থাকাকালীন যে কষ্টটি সবচেয়ে বেশি অনুভব করা যায়, তা হলো মায়ের হাতের রান্না খাওয়ার সুযোগ হারানো। মায়ের হাতে তৈরি সেই শৈশবের প্রিয় খাবারগুলোর স্বাদ প্রবাস জীবনে একটি মিষ্টি কিন্তু ব্যথাতুর স্মৃতি হয়ে ওঠে। বিদেশের খাবারের প্রাচুর্য থাকা সত্ত্বেও মায়ের হাতের রান্নার স্বাদ কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না।
বিদেশের উন্নত রেস্টুরেন্ট, নানা জাতের খাবারের প্রাচুর্য সত্ত্বেও মায়ের হাতের রান্নার স্বাদ কখনোই মিলতে পারে না। মায়ের হাতে তৈরি সেই সুগন্ধি ভাত, ডাল, মাছ, মুরগি, মিষ্টি – সবকিছুই মনে হয় এক অপরূপ স্বাদে ভরপুর। প্রতিটি কামড়ে মনে হয়, মা তাঁর সন্তানের জন্য সবচেয়ে ভালোটা দিতে চেয়েছিলেন। প্রবাসে থাকতে থাকতে মায়ের হাতের রান্নার স্বাদ মনে হয় এক অদম্য আকুলতা। কোনো বিশেষ দিন, কোনো উৎসব, কিংবা শুধু মাত্র একাকীত্বের মুহূর্তে এই আকুলতা আরো তীব্র হয়ে ওঠে। তখন মনে হয়, যদি একবারের জন্য মায়ের হাতে তৈরি খাবার খেতে পারতাম!
স্ত্রী-সন্তানদের না দেখতে পাওয়ার কষ্ট
যেসব প্রবাসী তাদের পরিবার থেকে দূরে থাকেন, তাদের কষ্টের আরেকটি বড় কারণ হলো স্ত্রী ও সন্তানদের না দেখতে পারা। সন্তানদের বেড়ে ওঠা, তাদের প্রথম কথা বলা, কিংবা স্কুলের প্রথম দিন — এসব গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত মিস করা একজন প্রবাসীর জন্য মানসিক চাপ সৃষ্টি করে। পরিবারের সঙ্গে কাটানো প্রতিটি মুহূর্তই তখন মূল্যবান হয়ে ওঠে।
স্ত্রী-সন্তানদের সাথে সম্পর্ক একটি মানুষের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। এই সম্পর্কই মানুষকে শক্তি দেয়, সাহস দেয়। কিন্তু যখন এই সম্পর্ক ভৌগোলিক দূরত্বের কারণে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, তখন মানুষ একাকীত্বের বোঝা বহন করে। প্রবাসীরা প্রতিদিনই এই বোঝা বহন করে।
সন্তানদের বেড়ে ওঠার প্রতিটি মুহূর্তই একজন বাবার জন্য অমূল্য। তাদের প্রথম পদক্ষেপ, প্রথম কথা, প্রথম স্কুল যাওয়া – এসব মুহূর্ত একজন বাবার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর মুহূর্ত। কিন্তু প্রবাসী বাবারা এই মুহূর্তগুলো মিস করেন। তাদের সন্তানদের বেড়ে ওঠা তারা ভিডিও কলের মাধ্যমে দেখেন, শুনেন। কিন্তু এই ভার্চুয়াল সংযোগ কখনোই সরাসরি সংযোগের মতো হতে পারে না।
আরও দেখুন: হতভাগা প্রবাসীদের কষ্ট নিয়ে আরও কিছু লেখা
শেষ কথা
প্রবাস জীবন মানেই স্বপ্ন ও ত্যাগের এক অনন্য মিশ্রণ। একদিকে আর্থিক উন্নতি ও ভবিষ্যতের জন্য সংগ্রাম, অন্যদিকে দেশ, পরিবার, এবং প্রিয়জনদের জন্য অব্যক্ত কষ্ট। প্রবাসে যাওয়া মানে শুধু দেশ বাড়ি ছেড়ে যাওয়া নয়, এটি মানে হচ্ছে নিজের স্বাচ্ছন্দ্য, পরিচিত পরিবেশ, প্রিয় মানুষদের থেকে দূরে থাকা। অচেনা জায়গায়, নতুন সংস্কৃতির মধ্যে নিজেকে মানিয়ে নিতে হয়। ভাষার বাধা, খাবারের অভ্যাস, জীবনযাত্রার পদ্ধতি – সবকিছুই নতুন করে শিখতে হয়।
প্রবাসীদের এই সংগ্রাম আমাদের জন্য অনুপ্রেরণা, কারণ তারা নিজেরা কষ্ট সহ্য করে পরিবার ও দেশের জন্য একটি ভালো ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। প্রবাসীদের জীবনের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা থাকা উচিত এবং তাদের ত্যাগকে সবসময় মূল্যায়ন করা উচিত।
Courstika Facebook Page, Courstika YouTube Channel.
Discussion about this post