প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, ঐতিহাসিক নিদর্শন এবং চমৎকার সব বিনোদন কেন্দ্রের সমন্বয়ে বৈচিত্রময় হয়ে আছে এই সোনার বাংলা। রাজধানী ছাড়াও এদেশের প্রতিটি জেলায় আছে একাধিক দর্শনীয় স্থান। তাই দেশ বিদেশের হাজার হাজার পর্যটক প্রতিনিয়ত ছুটে চলেছেন দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। সৌন্দর্য পিপাসুদের জন্য উপভোগ্য এমন ১০টি জনপ্রিয় দর্শনীয় স্থান সম্পর্কে এই আর্টিকেলে আলোচনা করা হচ্ছে। জেনে নিন বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য ১০ টি দর্শনীয় স্থানের পরিচিতি।
১. কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত
চট্টগ্রাম বিভাগের কক্সবাজার জেলায় বঙ্গোপসাগরের উপকূলে বিস্তৃত পৃথিবীর সর্ববৃহৎ সমুদ্র সৈকত ‘কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত। ১২০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য বিশিষ্ট সমুদ্র সৈকতের উত্তাল ঢেউ পর্যটকদের প্রতিনিয়ত হাতছানি দিতে থাকে। সমুদ্রের তীরে দাঁড়িয়ে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের দৃশ্য, বীচের আশেপাশের ঝাউবন, সামুদ্রিক মাছ ও উপজাতিদের বাজার কক্সবাজার ভ্রমণের উল্লেখযোগ্য আকর্ষণ।
ঢাকা থেকে সরাসরি বাসে, ট্রেনে অথবা বিমানে কক্সবাজার যেতে পারবেন। হানিফ, গ্রীন লাইন, এনা, শ্যামলী সহ বিভিন্ন বাসে ১০০০ থেকে ১৫০০ টাকায় কক্সবাজার যেতে পারবেন৷ কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে কক্সবাজার এক্সপ্রেস বা পর্যটক এক্সপ্রেস ট্রেনে শ্রেণিভেদে ৫০০ থেকে ১৭০০ টাকা ভাড়ায় কক্সবাজার যেতে পারবেন। থাকার জন্য পাবেন সাধারণ থেকে ফাইভ স্টার মানের আবাসিক হোটেল।
২. সেন্টমার্টিন দ্বীপ
কক্সবাজার জেলা শহর থেকে ১২০ কিলোমিটার দূরে মূল ভূখন্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন। নারকেল গাছের সারি, স্বচ্ছ পানির সৈকত, সামুদ্রিক প্রানীর প্রাচুর্য আপনাকে এক মুহুর্তেই মুগ্ধ করে দেবে। ঢাকা থেকে প্রথমে বাসে করে কক্সবাজারের টেকনাফ হয়ে সেখান থেকে সেন্টমার্টিন এর জাহাজে চেপে সেন্টমার্টিন দ্বীপ যেতে পারবেন।
রয়েল কোচ, হানিফ, তুবা লাইন, এস আলম সহ বিভিন্ন বাসে ১২০০ থেকে ২০০০ টাকা ভাড়া ঢাকা থেকে সরাসরি টেকনাফ যেতে পারবেন। সেখান থেকে কর্ণফুলী এক্সপ্রেস, বে-ওয়ান, এম. ভি. বার আউলিয়া সহ বেশ কয়েকটি জাহাজ ও ট্রলার পাবেন সেন্টমার্টিন যাওয়ার জন্য। রাতে থাকতে পারবেন দ্বীপের চমৎকার সব রিসোর্টে। সেন্টমার্টিন এর সুমিষ্ট ডাব ও সামুদ্রিক মাছ না খেয়ে আসবেন না কিন্তু।
৩. সুন্দরবন
বাংলাদেশের দর্শনীয় স্থান গুলোর মধ্যে অতি জনপ্রিয় একটি দর্শনীয় স্থান হচ্ছে সুন্দরবন। বাংলাদেশ ও ভারতের বৃহৎ একটি এলাকা নিয়ে বিস্তৃত পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন। বাংলাদেশের খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, পটুয়াখালী ও বরগুনা জেলার ৬০১৭ বর্গকিলোমিটার এলাকা নিয়ে এই বনের অবস্থান। বিখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগার সহ বিভিন্ন বণ্য প্রানী, নদনদী, গাছপালার এক অনবদ্য সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবেন সুন্দরবন ভ্রমণের মাধ্যমে। ঢাকা থেকে সরাসরি খুলনা বা মংলা বন্দরের বাস ধরে সুন্দরবন যেতে পারবেন৷ ঢাকার গুলিস্তান, সায়দাবাদ ও গাবতলি থেকে নিয়মিত এই সকল রুটে বাস চলাচল করে। রাতে থাকার জন্য ও খাওয়ার জন্য খুলনায় এবং মংলা বন্দরে বিভিন্ন মানের আবাসিক হোটেল ও রেস্টুরেন্ট রয়েছে।
৪. কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত
বরিশাল বিভাগের পটুয়াখালী জেলায় বঙ্গোপসাগরের তীর ঘেষে অবস্থিত কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত। ১৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য বিশিষ্ট এই বিচে সমুদ্রের উত্তাল ঢেউয়ের সাথে দেখতে পারবেন সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের দৃশ্য, ম্যানগ্রোভ বন, শুঁটকি পল্লী, ক্রাব আইল্যান্ড, ফাতরার বন, বার্মিজ মার্কেট ও কুয়া সহ অনেক কিছু। ঢাকার সায়দাবাদ, আব্দুল্লাহপুর, গাবতলী সহ বিভিন্ন জায়গা থেকে সরাসরি কুয়াকাটার উদ্যেশ্যে বাস ছেড়ে যায়। শ্রেণিভেদে বাস ভাড়া ৭৫০ টাকা থেকে ১২০০ টাকা। থাকার জন্য এখানে মাঝারি মানের বিভিন্ন আবাসিক হোটেল পাবেন। সামুদ্রিক মাছ, বিভিন্ন প্রকার ভর্তা সহ স্ট্রিট ফুড খাওয়ার সুযোগ তো রয়েছেই।
৫. জাফলং
প্রকৃতির কন্যা নামে সমাদৃত সিলেটের জাফলং ভারতের মেঘালয় রাজ্যের সীমান্ত ঘেঁষে অবস্থিত। সুউচ্চ পাহাড়, স্বচ্ছ পানির পিয়াইন নদী, ঝুলন্ত ব্রিজ ও ভারতের সীমান্তবর্তী এলাকার বিষ্ময়কর সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য হাজার হাজার পর্যটক জাফলং ছুটে যায়। ঢাকা থেকে সড়কপথে সৌদিয়া, এনা, এস আলম, শ্যামলী সহ বিভিন্ন বাসে সরাসরি সিলেট পৌঁছাতে পারবেন। তাছাড়া রেলপথে ও আকাশপথেও সিলেট যাওয়া যায়। সিলেট থেকে লোকাল বাস বা সিএনজি করে ৬০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছে যাবেন জাফলং। রাতে থাকার জন্য সিলেট শহরে হলি গেইট, হলি ইন, লা ভিলা সহ বিভিন্ন আবাসিক হোটেল রয়েছে। খাওয়া দাওয়ার জন্য যেতে পারেন জাফলং ভিউ বা সীমান্ত ভিউ রেস্টুরেন্টে।
৬. সাজেক ভ্যালি
বাংলাদেশের দর্শনীয় স্থান গুলোর মধ্যে অতি পরিচিত একটি দর্শনীয় স্থান হচ্ছে সাজেক ভ্যালি। রাঙামাটি জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলায় সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৮০০ উঁচুতে সাজেক ইউনিয়ন অবস্থিত। বর্তমান সময়ের বহুল আলোচিত এই পর্যটন কেন্দ্রে পাহাড়ের চূড়ায় মেঘের আনাগোনা দেখতে হাজারো পর্যটক ভিড় জমায়। দেখার মতো আরও আছে কংলাক পাহাড়, আদিবাসী গ্রাম সহ ১০০ টিরও বেশি রিসোর্ট। রাঙামাটি জেলায় অবস্থিত হলেও খাগড়াছড়ির দীঘিনালা হয়ে সাজেক যাওয়া সহজ। ঢাকা থেকে ১০০০ থেকে ১৫০০ টাকা বাস ভাড়ায় সরাসরি খাগড়াছড়ি যেতে পারবেন। সেখান থেকে চান্দের গাড়ি রিজার্ভ করে দীঘিনালা হয়ে সাজেক ঘুরে আসতে পারবেন। থাকা খাওয়ার জন্য আছে সাজেক রিসোর্ট, মেঘ মাচাঙ রিসোর্ট, লুসাই কটেজ সহ বেশ কয়েকটি রিসোর্ট।
৭. সীতাকুণ্ড
চট্টগ্রাম জেলার সীতাকুণ্ড উপজেলা এমন একটি পর্যটন এলাকা যেখানে একটি নয় বরং একাধিক পর্যন্ত কেন্দ্র রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি পর্যটন কেন্দ্র হলো গুলিয়াখালী সমুদ্র সৈকত, খৈয়াছড়া ঝর্ণা, বাঁশবাড়িয়া সমুদ্র সৈকত, মহামায়া লেক, ঝরঝরি ঝর্ণা ট্রেইল, চন্দ্রনাথ পাহাড় ইত্যাদি। ঢাকা থেকে সড়কপথে শ্যামলি, সৌদিয়া, ইউনিক পরিবহন সহ বেশ কয়েকটি বাসে সরাসরি সীতাকুণ্ড পৌঁছাতে পারবেন। খাওয়ার জন্য সীতাকুণ্ড বাজারে বিভিন্ন খাওয়ার হোটেল ও থাকার জন্য আবাসিক হোটেল রয়েছে। স্থানীয় বাহনে চেপে আবার কখনও কখনও পাহাড় ট্রেকিং করে সীতাকুণ্ডের সবগুলো স্পট ঘুরে দেখতে পারবেন।
৮. কাপ্তাই হ্রদ
পার্বত্য রাঙামাটি জেলার কাপ্তাই উপজেলায় ১১ হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে দক্ষিণ এশিয়ার সর্ববৃহৎ হ্রদ ‘কাপ্তাই হ্রদ’ অবস্থিত। নৌকা বা স্পিডবোটে করে হ্রদের বুকে ঘুরে বেড়ানোর সময় এক মুহুর্তের জন্যও মনে হবে না যে এটি একটি কৃত্রিম হ্রদ। হ্রদের ওপরে আছে বিখ্যাত ঝুলন্ত ব্রিজ। হ্রদের বুকে অবস্থিত ছোট ছোট দ্বীপ, প্রানী বৈচিত্র, হ্রদের আশেপাশের বিভিন্ন রিসোর্ট হ্রদের সৌন্দর্যকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। ঢাকার বিভিন্ন জায়গা থেকে সরাসরি বাসে করে কাপ্তাই হ্রদ পৌঁছাতে পারবেন। হ্রদের মধ্যের ছোট দ্বীপগুলোতে ভাসমান হোটেলে খাওয়ার ব্যবস্থা করতে পারেন। আর থাকার জন্য কাপ্তাই সরকারি রেস্ট হাউজ কিংবা সেনাবাহিনী, পিজিবি, পানি উন্নয়ন বোর্ড এর রেস্ট হাউজ হবে উপযুক্ত।
৯. হাকালুকি হাওর
সিলেটের মৌলভীবাজার জেলায় ২০ হাজার হেক্টর এলাকা জুড়ে দেশের অন্যতম বৃহৎ মিঠাপানির হাওর ‘হাকালুকি হাওর’ অবস্থিত। বৈচিত্র্যময় মাছের সমারোহ, অতিথী পাখির কলকাকলি, হাওরের পানিতে নৌকা নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর রোমাঞ্চকর মুহূর্ত যে কাউকে মুগ্ধ করবে। হাকালুকি হাওর যেতে চাইলে ঢাকার গাবতলী, সায়দাবাদ, ফকিরাপুল, আব্দুল্লাহপুর থেকে সিলেটগামী বাসে চেপে প্রথমে মৌলভীবাজারের কুলাউড়া যেতে হবে। বাস ভাড়া ৭০০ থেকে ৯০০ টাকা। কুলাউড়া থেকে অটো করে সরাসরি হাকালুকি হাওর পৌঁছাতে পারবেন৷ নৌকায় ওঠার সময় বাজার করে নিতে হবে যাতে নৌকায় রান্না করে খেতে পারেন। থাকতে চাইলে একমাত্র ভরসা বিল ইজারাদারদের কুটির।
১০. বাইতুল মুকাররম জাতীয় মসজিদ
রাজধানীর ব্যাস্ততম এলাকা গুলিস্তানের কাছেই বাংলাদেশের জাতীয় মসজিদ বাইতুল মুকাররম অবস্থিত। ৮ তলা ভবন বিশিষ্ট সুদর্শন এই মসজিদে এক ওয়াক্ত সালাত আদায় করতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লোকজন ভীড় জমায়। বিশেষ করে জুমার দিন সবথেকে বেশি লোকসমাগম ঘটে। এই মসজিদের তৃতীয় তলায় নারীদের নামাজের জন্যও বিশেষ ব্যবস্থা রয়েছে। নিচ তলায় আছে মার্কেট ও গুদাম। বাইতুল মুকাররম মসজিদে একসাথে ৩০ হাজার মুসুল্লি সালাত আদায় করতে পারে। বাংলাদেশের যে কোনো প্রান্ত থেকে মতিঝিল, গুলিস্তান অথবা পল্টন পৌঁছে সেখান থেকে পায়ে হেটে মসজিদে যেতে পারবেন।
এটা তো ছিলো বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় স্থানের একটি খন্ড চিত্র মাত্র। বাংলাদেশে যে কত শত দর্শনীয় স্থান রয়েছে তা হিসেব করে ওঠা মুশকিল। তবে বাংলাদেশ ভ্রমণের মিশনে উপরোক্ত দর্শনীয় স্থানগুলো সবার প্রথম তালিকায় রাখা উচিত।
Discussion about this post