বীরপুরুষ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর : কবিতাটি একটি কল্পনাপ্রবণ শিশুর মায়ের প্রতি ভালোবাসা, সুরক্ষা ও বীরত্বের চিত্র তুলে ধরেছে। শিশু কল্পনায় বিদেশ ভ্রমণের অনুভূতি সৃষ্টি করে, যেখানে সে তার মাকে পালকিতে বসিয়ে দূরে নিয়ে যাচ্ছে। পথিমধ্যে তারা নানা বিপদের সম্মুখীন হয়, বিশেষ করে ডাকাতদের আক্রমণ।
শিশুটি বীরের মতো লড়াই করে, শত্রুদের পরাজিত করে এবং তার মাকে রক্ষা করে। কবিতায় মাতৃভক্তি, সাহস, কল্পনার জগৎ ও বীরত্ব ফুটে উঠেছে। সহজ-সরল ভাষায় রচিত এই কবিতা শিশুদের মনে কল্পনার শক্তি এবং মায়ের প্রতি নিঃস্বার্থ ভালোবাসার অনুভূতি জাগ্রত করে।
বীরপুরুষ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দের ৭ই মে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি শুধু কবি নন; কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, দার্শনিক, গীতিকার, সুরস্রষ্টা, চিত্রশিল্পী, সমাজসেবী ও শিক্ষাবিদ। তাঁর রচনাভাণ্ডার বিশাল। তিনি কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নাটক রচনা করেছেন।
এ ছাড়াও তিনি বহু চিঠিপত্র লিখেছেন। ‘বীরপুরুষ’ কবিতাটি তাঁর ‘শিশু’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত। ১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দের ৭ই আগস্ট তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
বীরপুরুষ কবিতার শুরু এখানে
মনে করো, যেন বিদেশ ঘুরে
মাকে নিয়ে যাচ্ছি অনেক দূরে।
তুমি যাচ্ছ পালকিতে মা চড়ে
দরজা দুটো একটুকু ফাঁক করে,
আমি যাচ্ছি রাঙা ঘোড়ার ‘পরে
টগবগিয়ে তোমার পাশে পাশে।
রাস্তা থেকে ঘোড়ার খুরে খুরে
রাঙা ধুলোয় মেঘ উড়িয়ে আসে।
সন্ধে হলো, সূর্য নামে পাটে,
এলেম যেন জোড়াদিঘির মাঠে।
ধু ধু করে যে দিক-পানে চাই,
কোনোখানে জনমানব নাই,
তুমি যেন আপন মনে তাই
ভয় পেয়েছ-ভাবছ, ‘এলেম কোথা ! ‘
আমি বলছি, ‘ভয় করো না মা গো,
ওই দেখা যায় মরা নদীর সোঁতা।”
আমরা কোথায় যাচ্ছি কে তা জানে
অন্ধকারে দেখা যায় না ভালো।
তুমি যেন বললে আমায় ডেকে,
‘দিঘির ধারে ওই-যে কিসের আলো!”
এমন সময় ‘হারে রে রে রে রে
ওই যে কারা আসতেছে ডাক ছেড়ে।
তুমি ভয়ে পালকিতে এক কোণে
ঠাকুর-দেবতা স্মরণ করছ মনে,
বেয়ারাগুলো পাশের কাঁটাবনে
পালকি ছেড়ে কাঁপছে থরথর।
আমি যেন তোমায় বলছি ডেকে,
‘আমি আছি, ভয় কেন মা করো!”
তুমি বললে, ‘যাস নে খোকা ওরে’,
আমি বলি, ‘দেখো-না চুপ করে।’
ছুটিয়ে ঘোড়া গেলেম তাদের মাঝে,
ঢাল তলোয়ার ঝনঝনিয়ে বাজে,
কী ভয়ানক লড়াই হলো মা যে,
শুনে তোমার গায়ে দেবে কাঁটা।
কত লোক যে পালিয়ে গেল ভয়ে,
কত লোকের মাথা পড়ল কাটা।
এত লোকের সঙ্গে লড়াই করে,
ভাবছ খোকা গেলই বুঝি মরে।
আমি তখন রক্ত মেখে ঘেমে
বলছি এসে, ‘লড়াই গেছে থেমে’,
তুমি শুনে পালকি থেকে নেমে
চুমো খেয়ে নিচ্ছ আমায় কোলে
বলছ, ‘ভাগ্যে খোকা সঙ্গে ছিল
কী দুর্দশাই হতো তা না হলে!”
এই অধ্যায়ের অনুশীলনীমূলক কাজ
১. জেনে নিই।
শিশুরা কল্পনা করতে ভালোবাসে। এই কবিতাটিও তেমনি এক ছোট্ট শিশুর কল্পনা। কল্পনায় সে মায়ের সঙ্গে দূর দেশে যায়। পথে সে ডাকাতদের মোকাবেলা করে, বীরের মতো লড়াই করে মাকে রক্ষা করে।
২. শব্দগুলো পাঠ থেকে খুঁজে বের করি, অর্থ বলি এবং নতুন বাক্য লিখি।
টগবগিয়ে, রাঙা, পাট, জোড়াদিঘি, স্মরণ, বেয়ারা (বেহারা), থরথর, ঝনঝনিয়ে, দুর্দশা, সোঁতা
৩. প্রশ্নগুলোর উত্তর বলি ও লিখি।
ক. খোকা মাকে নিয়ে কোথায় যাচ্ছে?
খ. মা ও খোকা কীভাবে যাচ্ছে?
গ. তারা কখন জোড়াদিঘির ঘাটে পৌছাল? এমন সময় কী ঘটল?
ঘ. বেয়ারারা কোথায় পালাল?
ঙ. ‘ভাগ্যে খোকা সঙ্গে ছিল’ মা একথা বললেন কেন?
চ. বীরপুরুষ কে? সে কাদের হারিয়ে বীরপুরুষ হলো?
৪. নিচের শব্দগুলোর মধ্যে অর্থের পার্থক্য জেনে নিই ও শব্দ দিয়ে তৈরি বাক্যগুলো শুদ্ধ উচ্চারণে পড়ি।
কাটা – অঘ্রাণ মাসে ধান কাটা শেষ হয়েছে।
কাঁটা – চোরাকাঁটায় মাঠ ভরে আছে।
কোন – তুমি কোন কাজ করবে?
কোণ – ঘরের কোণে বসে থাকলে চলবে না, কাজে নেমে পড়ো।
৫. বিপরীত শব্দ জেনে নিই ও বাক্য তৈরি করি।
ভয় – সাহস – সাহসের কাছে সবাই পরাজিত হয়।
বিদেশ – স্বদেশ
দূরে – কাছে
সকাল – সন্ধ্যা
আলো – আঁধার
৬. ‘বীরপুরুষ’ কবিতায় ‘ধু-ধু’ শব্দ আছে, এ রকম আরও কয়েকটি শব্দ বাক্যে ব্যবহার করি।
ধু-ধু – চারদিকে মানুষজন নেই, গ্রামটা যেন ধু-ধু করছে।
হু-হু – হু-হু করে হাওয়া বইছে।
সোঁ-সোঁ – সোঁ-সোঁ করে বাতাস ছুটছে।
ঝনঝন – কাচের আয়নাটা ঝনঝন করে ভেঙে গেল।
ভনভন – ময়লা জায়গাটায় ভনভন করে মাছি উড়ছে।
৭. কবিতাটি স্পষ্ট ও শুদ্ধ উচ্চারণে স্বাভাবিক গতিতে আবৃত্তি করি।
৮. কর্ম-অনুশীলন।
আমি যদি বীরপুরুষ হতাম তাহলে কী করতাম তা লিখে জানাই।
◉ আরও দেখুন: চতুর্থ শ্রেণির বাংলা বইয়ের সকল গল্প-কবিতার সমাধান
শিক্ষার্থীরা, উপরে তোমাদের বাংলা মূল বই থেকে বীরপুরুষ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কবিতাটি আলোচনা করা হয়েছে। এই অধ্যায়ের অনুশীলনীমূলক কাজগুলোর সমাধান পেতে উপরের উত্তরমালা অপশনে ক্লিক করো। এছাড়াও তোমাদের পরীক্ষা প্রস্তুতির জন্য অতিরিক্ত বেশকিছু প্রশ্ন দেওয়া হয়েছে। এ প্রশ্নগুলো খুব ভালোভাবে অনুশীলন করার পরামর্শ থাকবে।
Discussion about this post