ভাবুক ছেলেটি : “ভাবুক ছেলেটি” পাঠে বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসুর শৈশব, শিক্ষাজীবন, গবেষণা ও অবদান তুলে ধরা হয়েছে। ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন কৌতূহলী ও ভাবুক প্রকৃতির। প্রকৃতি ও বিজ্ঞানের প্রতি তাঁর গভীর অনুরাগ ভবিষ্যতে তাঁকে বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানীতে পরিণত করে।
তিনি পদার্থবিজ্ঞান ও উদ্ভিদবিজ্ঞানে গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা করেন। তাঁর আবিষ্কৃত অতিক্ষুদ্র তরঙ্গ প্রযুক্তি আজকের বেতার, টেলিভিশন ও রাডারের ভিত্তি স্থাপন করেছে। তিনি দেখিয়েছেন উদ্ভিদও অনুভূতি প্রকাশ করে, যা ক্রেসকোগ্রাফ যন্ত্রের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়।
ভাবুক ছেলেটি
ছেলেটি তেমন দুরন্ত নয়। বয়স দশ-এগারো হবে। পড়াশোনায় সে ভালো, খেলাধুলাও করে। তবে সময় পেলেই গাছ-গাছালি পর্যবেক্ষণ করে। রোদ-বৃষ্টির ব্যাপারটাও সে দেখে। আকাশে মেঘ ডাকে। বিদ্যুৎ চমকায়। বাজ পড়ে। কেন এমন হয়? অবাক বিস্ময়ে সে ভাবে। ঝড়ে গাছপালা ভেঙে গেলে বাবাকে প্রশ্ন করে।
আচ্ছা বাবা, গাছ ভেঙে গেলে, ওদেরকে কাটলে ব্যথা পায় না?
ছেলের কথা শুনে মা হাসেন। বাবা কিন্তু হাসলেও ছেলের প্রশ্নের জবাব দেওয়ার চেষ্টা করেন।
ওর বাবা ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। আগে স্কুলে শিক্ষকতা করেছেন।
ছেলেটির বাবার বাড়ি বিক্রমপুরের রাঢ়িখাল গ্রামে। তবে তার জন্ম ময়মনসিংহে- ১৮৫৮ সালের ৩০শে নভেম্বর। ওর পড়াশোনায় হাতেখড়ি হয়েছিল বাড়িতেই। তারপর ময়মনসিংহে স্কুল শিক্ষার ধাপ শেষ করে ভর্তি হয় কলকাতায়। ১৮৭৪ সালে সে সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুল থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে প্রবেশিকা পরীক্ষা পাস করে।
১৮৭৮ সালে সে এফএ পরীক্ষাতেও কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হয়। তারপর ১৮৮০ সালে বিজ্ঞান শাখায় বিএস সি পাস করে বিলেতে যায় ডাক্তারি পড়তে।
সেই ছেলেটিই বড় হয়ে বাঙালি বিজ্ঞানী হিসেবে প্রথম জগৎ জোড়া খ্যাতি অর্জন করে। সেই ভাবুক ছেলেটিই পরবর্তীকালে হয়ে ওঠেন বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু।
জগদীশচন্দ্র এক বছর ডাক্তারি পড়ার পর ১৮৮১ সালে ইংল্যান্ডের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এখান থেকে তিনি উচ্চশিক্ষা লাভ করেন। ১৮৮৫ সালে দেশে ফিরে এসে কলকাতায় প্রেসিডেন্সি কলেজে পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক পদে যোগ দেন। তখন ভারতবর্ষ শাসন করত ইংরেজরা।
এ সময় একজন ইংরেজ অধ্যাপক এদেশীয় একজন অধ্যাপকের চেয়ে অনেক বেশি বেতন পেতেন। জগদীশচন্দ্র অস্থায়ীভাবে চাকরি করছিলেন বলে তাঁর বেতন আরও এক ভাগ কেটে নেওয়া হয়। এর প্রতিবাদে তিনি দীর্ঘ তিন বছর বেতন না নিয়ে কর্তব্য পালন করেন। শেষ পর্যন্ত ইংরেজ সরকার তাঁকে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হন। সকল বকেয়া পরিশোধ করে তাঁকে চাকরিতে স্থায়ী করা হয়।
ধীরে ধীরে তিনি বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু হয়ে ওঠেন। লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডিএসসি ডিগ্রি প্রদান করে।
জগদীশচন্দ্র বসু নানা বিষয়ে গবেষণা করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন যে, উদ্ভিদ ও প্রাণীর জীবনের মধ্যে অনেক মিল আছে। ১৮৯৫ সালে তিনি অতিক্ষুদ্র তরঙ্গসৃষ্টি আবিষ্কার করেন।
কোনো তার ছাড়া তরঙ্গ এক স্থান থেকে অন্য স্থানে প্রেরণে সফলতা অর্জন করেন। তারই প্রয়োগ ঘটেছে আজকের বেতার, টেলিভিশন, রাডারসহ বিশ্বের অধিকাংশ তথ্যের আদান-প্রদান এবং মহাকাশ যোগাযোগের ক্ষেত্রে।
কিন্তু জীবদ্দশায় তিনি তাঁর এই সাফল্যের স্বীকৃতি পাননি। তাঁর করা পরীক্ষণগুলো ইউরোপীয় বিজ্ঞানীদের চমকে দেয়। তাঁর পাণ্ডিত্যপূর্ণ বক্তৃতা শুনে বিখ্যাত বিজ্ঞানী অলিভার লজ ও লর্ড কেলভিন তাঁকে বিলেতে অধ্যাপনা করার জন্য আমন্ত্রণ জানান। কিন্তু দেশের কল্যাণের জন্যই তিনি নিজ দেশে ফিরে আসেন।
তাঁর আশ্চর্য সব আবিষ্কার দেখে বিখ্যাত বিজ্ঞানী আইনস্টাইন বলেছিলেন: জগদীশচন্দ্র বসু এতগুলো আবিষ্কার না করে যদি একটি আবিষ্কারও করতেন তবু তাঁর জন্য আমাদের মূর্তি স্থাপন করতে হতো।
জগদীশচন্দ্র বাংলা ভাষাও অনেক লিখেছেন, বিশেষ করে শিশুদের জন্য। অনেকের মতে, তাঁর লেখা ‘নিরুদ্দেশের কাহিনি’ বাংলা ভাষায় লেখা প্রথম বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি। এটি পরে ‘পলাতক তুফান’ নামে তাঁর ‘অব্যক্ত’ নামক বইয়ে ছাপা হয়।
১৯১৭ সালে ব্রিটিশ সরকার তাঁকে ‘নাইট’ উপাধি দেন। তাই উপাধিসহ তাঁর নাম হয় স্যার জগদীশচন্দ্র বসু।
সে বছরই তিনি প্রতিষ্ঠা করেন বসু বিজ্ঞান মন্দির। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি সেই বিজ্ঞান মন্দিরে গবেষণা পরিচালনা করেন। তিনি ক্রেসকোগ্রাফ নামের একটি যন্ত্র উদ্ভাবন করেন। এই যন্ত্রের মাধ্যমে তিনি সূক্ষ্মভাবে প্রমাণ করে দেখান যে, বিভিন্ন পরিস্থিতিতে উদ্ভিদ প্রাণীদের মতোই সাড়া দেয়।
স্যার জগদীশচন্দ্র বসু ১৯৩৭ সালের ২৩শে নভেম্বর মৃত্যুবরণ করেন। বিজ্ঞান শিক্ষা ও চর্চার ক্ষেত্রে তাঁর সফলতা বিজ্ঞানী গ্যালিলিও-নিউটনের সমকক্ষ ছিল। জগদীশচন্দ্র বসু বাংলাদেশের গৌরব। তিনি পৃথিবীকে দেখিয়েছেন বিজ্ঞানের নতুন পথ।
এই অধ্যায়ের অনুশীলনীমূলক কাজ
১. শব্দগুলো পাঠ থেকে খুঁজে বের করি। অর্থ বলি।
পরীক্ষণ, পাণ্ডিত্যপূর্ণ, এফএ, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি, প্রবেশিকা
২. ঘরের ভিতরের শব্দগুলো খালি জায়গায় বসিয়ে বাক্য তৈরি করি।
কল্পকাহিনি, আবিষ্কার, কল্যাণ, পাণ্ডিত্যপূর্ণ, দুরন্ত, পদার্থবিজ্ঞানের, বিষয়ে, বাড়িতে, অতিক্ষুদ্র, কর্তব্য, প্রাণী জীবনের
ক. তাঁর ______ বক্তৃতা শুনে তাঁকে অধ্যাপনা করার আমন্ত্রণ জানানো হয়।
খ. দেশের ______ করার জন্যই তিনি নিজ দেশে ফিরে আসেন।
গ. জগদীশচন্দ্র বসুর আশ্চর্য সব ______ দেখে আইনস্টাইন মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন।
ঘ. জগদীশচন্দ্র বসুর ‘নিরুদ্দেশের কাহিনি’ বাংলা ভাষায় লেখা প্রথম বৈজ্ঞানিক ______।
ঙ. ছেলেটি তেমন ______ নয়।
চ. মেঘ ডেকে আকাশে বিদ্যুৎ চমকে বাজ পড়লে অবাক ______ ভাবে।
ছ. ওর পড়াশোনার শুরু ______ ।
জ. প্রেসিডেন্সি কলেজে ______ অধ্যাপক পদে যোগ দেন।
ঝ. প্রতিবাদে তিনি দীর্ঘ তিন বছর বেতন না নিয়ে ______ পালন করেন।
ঞ. তিনি দেখিয়েছিলেন যে, উদ্ভিদ ও ______ মধ্যে অনেক মিল আছে।
ট. তিনি ______ তরঙ্গসৃষ্টি আবিষ্কার করেন।
৩. নিচের প্রশ্নগুলোর উত্তর লিখি ও বলি।
ক. ভাবুক ছেলেটি আসলে কে ছিলেন?
খ. তিনি ছোটোবেলায় কী কী নিয়ে ভাবতেন?
গ. তিনি কবে, কোথা থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন?
ঘ. জগদীশচন্দ্র বসু কী যন্ত্র আবিষ্কার করেন? এটি দিয়ে তিনি কী প্রমাণ করেন?
ঙ. বিজ্ঞান শিক্ষা ও চর্চার ক্ষেত্রে তাঁর সফলতাকে কোন কোন নামকরা বৈজ্ঞানিকের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে?
চ. তাঁর সম্পর্কে আইনস্টাইন কী বলেছিলেন? কেন বলেছিলেন?
৪. কথাগুলো বুঝে নিই।
শিক্ষার ধাপ — প্রাথমিক বিদ্যালয়, উচ্চ বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয় হলো একটার পর একটা শিক্ষার ধাপ।
বকেয়া পরিশোধ — কারো নিকট কোনো টাকা-পয়সা পাওনা থাকলে যদি সময়মতো দেওয়া না হয় তখন তা বকেয়া হয়ে যায়। পরে যদি আগের পাওনা দিয়ে দেওয়া হয় তবে তাকে বলে বকেয়া পরিশোধ।
অন্যতম — অনেকের মধ্যে একজনকে বলা হয় অন্যতম। কোনো কিছুকে বিশেষভাবে বোঝানোর জন্য ‘অন্যতম’ শব্দটি ব্যবহার করা যায়।
তথ্যের আদান-প্রদান — সংবাদ, প্রকৃত অবস্থা বা সত্যের আদান-প্রদান। আজকের দিনে লিখে, ছাপিয়ে অথবা বেতার, টেলিভিশন, ফোন, ইন্টারনেটের সাহায্যে যত কিছু পাওয়া যায়, পাঠানো যায় তার সবই তথ্যের আদান-প্রদান।
নাইট উপাধি — নাইট উপাধি ব্রিটিশ রাজা বা রানির দেওয়া অত্যন্ত সম্মানজনক উপাধি। এ উপাধি যাঁরা পান তাঁদের ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করা হয়।
৬. কর্ম-অনুশীলন।
‘বিজ্ঞান শিক্ষাই সভ্যতা বিনির্মাণের একমাত্র উপায়।’ বিষয়টি নিয়ে শিক্ষকের সহায়তায় বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করি।
৭. আমার জানা যেকোনো একজন বিজ্ঞানী সম্পর্কে ১০টি বাক্য লিখি।
◉ আরও দেখুন: পঞ্চম শ্রেণির বাংলা বইয়ের সকল গল্প-কবিতার সমাধান
শিক্ষার্থীরা, উপরে তোমাদের বাংলা মূল বই থেকে ভাবুক ছেলেটি গল্পটি আলোচনা করা হয়েছে। এই অধ্যায়ের অনুশীলনীমূলক কাজগুলোর সমাধান পেতে উপরের উত্তরমালা অপশনে ক্লিক করো। এছাড়াও তোমাদের পরীক্ষা প্রস্তুতির জন্য অতিরিক্ত বেশকিছু প্রশ্ন দেওয়া হয়েছে। এ প্রশ্নগুলো খুব ভালোভাবে অনুশীলন করার পরামর্শ থাকবে।
Discussion about this post