মানসিংহ ও ঈশা খাঁ গল্পের বর্ণনামূলক প্রশ্ন উত্তর : ইব্রাহীম খাঁ এই নাট্যাংশে হাজির করেছেন ঈসা খাঁ ও রাজপুত বীর মানসিংহের বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধ ও মহানুভবতার কাহিনি। বাংলার পাঠান বীর ঈসা খাঁ দ্বন্দ্বযুদ্ধে নিহত করেন মানসিংহের বীর জামাতাকে। প্রতিশোধ নিতে মানসিংহ এগারোসিন্ধু ময়দানে ঈসা খাঁকে যুদ্ধে আহ্বান করেন। ঈসা খাঁ বীরত্বের সঙ্গে তা গ্রহণও করেন। যুদ্ধ চলাকালে হঠাৎ মানসিংহের তলোয়ার ভেঙে গেলে তিনি ভীত হয়ে পড়েন।
কিন্তু ঈসা খাঁ নিরস্ত্র মানসিংহকে আঘাত না করে তাঁর হাতে অপর একটি তলোয়ার তুলে দেন। ঈসা খাঁর বীরত্ব ও ঔদার্যে মানসিংহ বিস্মিত হয়ে তলোয়ার ছুড়ে ফেলে জানান, ঈসা খাঁর সঙ্গে তাঁর কোনো যুদ্ধ নেই। তারপর দুই বীর পরস্পরের সঙ্গে আলিঙ্গনে আবদ্ধ হন। দুজনেই ভারতের মোগল-পাঠান আর হিন্দু-মুসলমানের বন্ধুত্ব ও মিলনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হন। নাট্যাংশটিতে মোগল-ভারত আমলের বীরত্ব, মহানুভবতা ও ভ্রাতৃত্ববোধের পরিচয় ফুটে উঠেছে। প্রতিফলিত হয়েছে মানুষের উদারতা ও মহানুভবতা।
মানসিংহ ও ঈশা খাঁ গল্পের বর্ণনামূলক প্রশ্ন উত্তর
বর্ণনামূলক প্রশ্ন—১: নিচের ক ও খ প্রশ্ন দুটির উত্তর দাও:
ক. ‘চোখের সামনে যা ঘটে গেল, দুর্জয়সিংহ, তাতে বিশ্বাস না-করি কেমনে, তাই বলো।’—মানসিংহ এ কথা কেন বলেছেন? ব্যাখ্যা কর।
খ. ‘মানসিংহ ও ঈসা খাঁ’ নাটকে ঈসা খাঁর চরিত্র কেমনভাবে ফুটে উঠেছে? বিশ্লেষণ কর।
১ নম্বর বর্ণনামূলক প্রশ্নের উত্তর
ক. মানসিংহের এই উক্তিটি তাঁর বিশ্বাসের পরিবর্তন এবং ঘটনার বিস্ময়কর পরিণতির প্রতি তাঁর প্রতিক্রিয়া নির্দেশ করে। মানসিংহ শুরুতে ঈসা খাঁর ক্ষমতা ও তলোয়ারের প্রতি তেমন শ্রদ্ধাশীল ছিলেন না। তিনি ভাবতেন যে, তিনি শক্তিশালী এবং ঈসা খাঁ কোনোভাবেই তার সমকক্ষ নয়। কিন্তু যখন মানসিংহ দেখলেন যে, ঈসা খাঁয়ের হাতে তার জামাতা নিহত হল, তখন তার বিশ্বব্যাপী ধারণা বদলে যায়। এই ঘটনা তাকে ভেঙে দেয়, কারণ তার বিশ্বাস ছিল যে, রাজপুতনা ও মোগলরা শক্তিশালী, পরস্পর পরস্পরের শত্রু, এবং সেই শত্রুদের মধ্যে এমন ঘটনা ঘটানো সম্ভব নয়। কিন্তু জামাতার মৃত্যু মানে ছিল যে, অবিশ্বাস্য পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
এটা ছিল মানসিংহের দুঃখের এবং হতাশার অভিব্যক্তি, কারণ তার সামনে ঘটে যাওয়া ঘটনাটি ছিল একেবারে অবিশ্বাস্য। তিনি দুর্জয়সিংহকে বলছেন যে, এই দৃশ্য নিজ চোখে দেখার পর, আর কোনো সন্দেহ রাখা সম্ভব নয়। মানসিংহ বুঝতে পারছেন, ঈসা খাঁ এতটাই দক্ষ এবং শক্তিশালী, যে তাকে অন্ধভাবে অসম্মান করা সম্ভব নয়। তার কাছ থেকে এমন একটি বিপত্তি ঘটলে, অন্যরা কীভাবে তা বুঝতে পারবে, তার উপরেও মানসিংহ কিছুটা চিন্তা করছেন।
এই উক্তি থেকে মানসিংহের হতাশা, সম্মান হারানোর ভয়, এবং নিজের ধারণার পতন বোঝা যায়। তিনি বোঝাতে চাইছেন যে, এটা তো বাস্তবেই ঘটে গেল, তাকে বিশ্বাস না করার আর কোনো উপায় নেই।
খ. ঈসা খাঁ নাটকে একটি বীর, উদার, এবং নৈতিক চরিত্র হিসেবে ফুটে উঠেছে। তার চরিত্রের মধ্যে শক্তি, সাহস, মানবিকতা এবং সম্মান একসাথে মিশে রয়েছে। তিনি একজন দক্ষ যোদ্ধা, তবে তার শক্তি কেবল যুদ্ধের কৌশলেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং তার মনুষ্যত্ব, উদারতা ও মহানুভবতাতেও প্রতিফলিত হয়। ঈসা খাঁয়ের সামরিক দক্ষতা ও আত্মবিশ্বাস স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান, যখন তিনি যুদ্ধের ময়দানে আসেন এবং মানসিংহের জামাতাকে হত্যা করার পরও তিনি তার প্রতি সম্মান বজায় রাখেন। তিনি জানতেন যে, যুদ্ধের শেষে একে অপরকে সম্মানিত করা উচিত, কারণ প্রকৃত যোদ্ধার পরিচয় কেবল যুদ্ধের মাধ্যমে নয়, মানবিকতা, শ্রদ্ধা এবং ন্যায়পরায়ণতার মাধ্যমেও উদ্ভাসিত হয়।
ঈসা খাঁ যখন মানসিংহের তলোয়ারের আহ্বানে সাড়া দেন, তখন তিনি তাকে নিজের তলোয়ার তুলে দেন, যা তার মহানুভবতার প্রতীক। তলোয়ারের ডগায় রক্ত দিয়ে উত্তর লেখার পরিবর্তে মানসিংহকে সম্মান প্রদর্শন করা ঈসা খাঁয়ের মর্যাদাপূর্ণ মনোভাব নির্দেশ করে। এর মাধ্যমে ঈসা খাঁ কেবল শক্তির মাধ্যমে শত্রুকে পরাস্ত করার জন্য যুদ্ধ করেননি, বরং তার মধ্যে এক ধরনের দুর্দান্ত উদারতা এবং শত্রুর প্রতি সম্মান রয়েছে, যা তাকে সবার কাছে শ্রদ্ধার পাত্র করে তোলে। নাটকে ঈসা খাঁ শুধু একজন যোদ্ধা নন, তিনি একজন মানবিক নেতা, যিনি যুদ্ধের ময়দানে সম্মান, ন্যায়, এবং উদারতার চর্চা করেন। তাঁর এই গুণাবলী তাকে সেরা যোদ্ধার পাশাপাশি একজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি হিসেবে তুলে ধরে, যিনি সত্যিকার অর্থে শক্তির পাশাপাশি মানবিক মূল্যবোধকেও গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন।
বর্ণনামূলক প্রশ্ন—: নিচের ক ও খ প্রশ্ন দুটির উত্তর দাও:
ক. ‘এই কাহিনি শুনে রাজপুতনার নারীরা হাসবে, শত্রুরা উপহাস করবে।’—এই উক্তিটি কে করেছেন? কেন করেছেন?
খ. নাটকের শেষে মানসিংহ ও ঈসা খাঁর মধ্যে যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে, তা থেকে কী শিক্ষা পাওয়া যায়? নিজের মতামত প্রকাশ কর।
২ নম্বর বর্ণনামূলক প্রশ্নের উত্তর
ক. এই উক্তিটি মানসিংহ বলেছেন। তিনি এই কথা বলেছেন কারণ ঈসা খাঁর হাতে তার জামাতা নিহত হওয়ার ঘটনা তার কাছে অত্যন্ত লজ্জাজনক এবং অপমানজনক ছিল।
মানসিংহ, যিনি রাজপুত সমাজের অংশ, তার জন্য এ ধরনের ঘটনা ছিল পরিবার এবং তার নিজের সম্মানের জন্য একটা বড় ধাক্কা। জামাতা একজন দক্ষ এবং সাহসী যোদ্ধা ছিল, কিন্তু তার মৃত্যু যেভাবে ঘটল, তাতে মানসিংহের ব্যক্তিগত সম্মান ও রাজপুত পরিবারের সম্মান ক্ষুন্ন হয়েছিল। মানসিংহের ভয় ছিল যে, এই ঘটনা জানার পর রাজপুতনার নারীরা হাসবে এবং শত্রুরা তাদের দুর্বলতা ও পরাজয়কে উপহাস করবে।
এর ফলে রাজপুতদের কাছে তিনি এক ধরনের অবমাননা বোধ করেছিলেন, যা তার জন্য অত্যন্ত কষ্টকর ছিল। রাজপুত পরিবারের মর্যাদার কারণে মানসিংহের মনে হচ্ছিল যে, তার জামাতার মৃত্যুর কাহিনী হয়তো রাজপুতদের কাছে একটি হাস্যকর বিষয় হয়ে দাঁড়াবে, যা তার নিজের পক্ষে খুব অপমানজনক হবে।
খ. নাটকের শেষে মানসিংহ ও ঈসা খাঁর মধ্যে যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে, তা মানবিক সম্পর্কের একটি অনন্য উদাহরণ। তারা প্রথমে পরস্পরের শত্রু ছিলেন, এবং তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব ছিল। তবে যুদ্ধের ময়দানে একে অপরের সম্মান প্রদর্শন এবং সাহসের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তারা একে অপরের প্রতি গভীর সম্মান এবং মানবিকতা প্রদর্শন করেন।
মানসিংহ যখন ঈসা খাঁকে “কাপুরুষ” বলে তিরস্কার করেছিলেন, তখন ঈসা খাঁ তাকে সম্মান দিয়ে খোলামনে উত্তর দিয়েছিলেন, এবং পরে মানসিংহকে শত্রু হিসেবে বিবেচনা না করে, বরং তার প্রশংসা করেন। তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে, যখন তারা একে অপরকে বিশ্বস্ত ভাইয়ের মতো আলিঙ্গন করেন, যা প্রমাণ করে যে, শক্তি ও শত্রুতা চিরস্থায়ী নয়, এবং সবচেয়ে বড় শক্তি হলো মানুষের মধ্যে একে অপরের প্রতি মর্যাদা, উদারতা ও শ্রদ্ধা।
এটি আমাদের শেখায় যে, জীবনে শত্রুতা ও প্রতিশোধের আগুনে পুড়ে না গিয়ে, আমাদের উচিত শান্তি ও সমঝোতা খোঁজা। আমরা যদি নিজেদের মধ্যে দয়ার চোখে তাকাই এবং একে অপরকে বুঝি, তাহলে বিশ্বের সব ধরনের বিভেদ এবং শত্রুতা দূর করা সম্ভব। ঈসা খাঁ ও মানসিংহের সম্পর্ক আমাদের শেখায়, সম্মান, উদারতা এবং মানবিকতা হল জীবনকে সুন্দর এবং শান্তিপূর্ণ করতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গুণ। তাদের সম্পর্কের এই পরিবর্তন আমাদের প্রমাণ দেয় যে, বিভেদ থাকা সত্ত্বেও একে অপরকে শ্রদ্ধা ও সম্মান দিয়ে সম্পর্ক তৈরি করা সম্ভব এবং সত্যিকার বন্ধুত্বের ক্ষেত্রে জাত, ধর্ম, বর্ণ কিংবা পেশার ভেদাভেদ কোনো ব্যাপার নয়।
আরও দেখো—অষ্টম শ্রেণির বাংলা গল্প-কবিতার সৃজনশীল প্রশ্ন উত্তর
শিক্ষার্থীরা, উপরে তোমাদের আনন্দপাঠ বই থেকে মানসিংহ ও ঈশা খাঁ গল্পের বর্ণনামূলক প্রশ্ন উত্তর নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। তোমাদের পরীক্ষা প্রস্তুতির জন্য ৩টি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন এখানে দেওয়া হয়েছে। এ প্রশ্নগুলো খুব ভালোভাবে অনুশীলন করার পরামর্শ থাকবে। পিডিএফ ফরমেটে উত্তরমালা সংগ্রহের জন্য ‘Answer Sheet’ অপশনে ক্লিক করো। এছাড়াও বাংলা বইয়ের গল্প-কবিতার সৃজনশীল, জ্ঞানমূলক, অনুধাবনমূলক এবং বহুনির্বাচনি সমাধানের জন্য উপরের লিংকটি অনুসরণ করো।
Discussion about this post