মুক্তিযুদ্ধে বিদেশি সংবাদপত্র রেডিও টেলিভিশনের ভূমিকা গণমাধ্যম : ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিদেশি গণমাধ্যম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, যা বিশ্বজনমত গঠনে সহায়তা করে। এসকল গণমাধ্যমের মধ্যে রয়েছে— সংবাদপত্র, রেডিও এবং টেলিভিশন। এই গণমাধ্যমগুলো
পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যা, নারী ধর্ষণ, নৃশংস বর্বরতা, ধ্বংসযজ্ঞ, শরণার্থীদের দুর্ভোগ বহির্বিশ্বে তুলে ধরায় বিশ্ববাসী মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ঘটনা জানতে পেরেছে। এতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন ত্বরান্বিত হয়েছে। বিদেশি প্রচারমাধ্যম বিশেষ করে রেডিওর বিভিন্ন খবর, কথিকা, গান মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রেরণা দেয় এবং সাহস জুগিয়ে বিজয়ের পথ সুগম করে।
মুক্তিযুদ্ধে বিদেশি সংবাদপত্র রেডিও টেলিভিশনের ভূমিকা গণমাধ্যম
২৫ মার্চ গণহত্যা শুরুর প্রাক্কালে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী বিদেশি সব সাংবাদিককে হোটেলে অবরুদ্ধ করে রাখে এবং সব ধরনের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। দেশের খবর যাতে বহির্বিশ্বের মানুষ জানতে না পারে, সে জন্য সব বিদেশি সাংবাদিকদের দেশত্যাগের নির্দেশ দেয়।
বেশ কয়েকজন বিদেশি সাংবাদিক এই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে হোটেলের ছাদে উঠে ঢাকার অবস্থা পর্যবেক্ষণ করেন ও কেউবা রাতের আঁধারে খবর সংগ্রহে বেরিয়ে পড়েন। তারা খবর সংগ্রহ করে ছবিসহ নিউজ বিদেশগামী প্লেনের বিভিন্ন যাত্রীর মাধ্যমে নিজ নিজ দেশের পত্রিকায় পাঠিয়ে দেন। পরদিন ২৬ মার্চ কলকাতা আকাশবাণী, বিবিসিসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম গুরুত্ব সহকারে গণহত্যার বিবরণ প্রচার করতে থাকে।
১. ডেইলি টেলিগ্রাফ
লন্ডনের ডেইলি টেলিগ্রাফ ৩০ মার্চ ১৯৭১ সালে সাংবাদিক সাইমন ড্রিংয়ের একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে, যিনি ২৫ মার্চের গণহত্যার সময় বাংলাদেশে ছিলেন। প্রতিবেদনে তিনি উল্লেখ করেন, পাকিস্তান সেনাবাহিনী ঠান্ডা মাথায় ২৪ ঘণ্টা অবিরাম গোলাবর্ষণ করে প্রায় ১৫ হাজার মানুষকে হত্যা করে। পুলিশ সদর দপ্তর, ছাত্রাবাস, দোকানপাটে নির্বিচারে হত্যা ও আগুন জ্বালিয়ে দেওয়ার খবর দেয়। এতে তারা আরও লেখে, বাঙালি জনগণ যে স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিল, তা গত সপ্তাহে বেদনাদায়ক এক গণহত্যার মাধ্যমে শেষ হয়ে গেছে। এই দুঃস্বপ্ন ভুলতে তাদের কয়েক প্রজন্ম লেগে যাবে।
২. টাইম ম্যাগাজিন
টাইম ম্যাগাজিন ১৯৭১ সালের ১২ এপ্রিল এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে তারা উল্লেখ করে, পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনী সম্ভবত কিছু সময়ের জন্য ঢাকাসহ পূর্বাংশের শহরগুলোর নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে পারবে। কিন্তু অনির্দিষ্টকাল ৫৪ হাজার বর্গমাইলের বিশাল অঞ্চল বাগে রাখতে পারবে না। কারণ ব্রিটিশরাজ ১৯১১ সালে বাঙালির ভয়ে রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লিতে স্থানান্তর করেছিল।
৩. নিউজউইক
১৯৭১ সালের ১২ এপ্রিল নিউজউইক ‘একটি আদর্শের মৃত্যু’ শিরোনামে একটি নিউজ ছাপে। এতে বাঙালির আত্মবিশ্বাস, গণজাগরণ ও পাকিস্তানিদের প্রতি তাদের ঘৃণার বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে তুলে ধরা হয়। একদল লিকলিকে রোগা হতদরিদ্র বাঙালি কীভাবে সড়কি, বল্লম আর বাঁশের লাঠি দিয়ে যশোরে ১ হাজার পাকিস্তানি সুসজ্জিত বাহিনীকে আটকে রেখেছিল, তার এক সুন্দর বর্ণনা রয়েছে প্রতিবেদনটিতে।
৪. দ্য অবজারভার
লন্ডনের দ্য অবজারভার ১৯৭১ সালের ১৮ এপ্রিল ‘স্বপ্নভঙ্গের পথে বাংলাদেশ’ শিরোনামে এক নিউজ প্রকাশ করে। এতে পাকিস্তানি বাহিনীর নির্মম হত্যাযজ্ঞ, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগে, ছাত্রহত্যা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক দর্শন বিভাগের বিভাগীয় প্রধান জি সি দেব, পরিসংখ্যান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ড. এ এন মনিরুজ্জামান, হিন্দু ছাত্রাবাস জগন্নাথ হলের প্রভোস্ট ও ইংরেজি বিভাগের রিডার ড. অবিনশ্বর চক্রবর্তী ছাড়াও আরও ৫ জন প্রভাষককে হত্যার খবর ছাপে।
৫. দ্য উইকলি নিউ এজ
নয়াদিল্লি থেকে ‘দ্য উইকলি নিউ এজ’ পত্রিকা ১৯৭১ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর ‘বিজয় নিশ্চিত’ শিরোনামে এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে তারা উল্লেখ করে, গত সপ্তাহে আমরা বাংলাদেশের ছয় মাসের লড়াইয়ের ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখতে পাই, মুক্তিযোদ্ধারা বর্তমানে যেভাবে হয়রানি করছে তা আরও তীব্র হলে সামরিক দিক থেকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অবস্থান ভেঙে পড়বে। মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয়ের ব্যাপারে আর কোনো সন্দেহ নেই। এখন কাজ হচ্ছে এটিকে ত্বরান্বিত করা।
তা ছাড়া আকাশবাণীর দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, পঙ্কজ সাহা, উপেন তরফদার, এম আর আখতার মুকুলের ‘চরমপত্র’, স্টেটম্যান পত্রিকার মানস ঘোষসহ নাম না জানা অনেক সাংবাদিক বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন, যা বাঙালি জাতি কৃতজ্ঞচিত্তে আজীবন স্মরণ করবে।
আরো দেখো: ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান সকল অধ্যায়ের সমাধান
শিক্ষার্থীরা, উপরে মুক্তিযুদ্ধে বিদেশি সাংবাদিকদের ভূমিকা তুলে ধরা হয়েছে। অন্যান্য বিষয়ের নোট ও সাজেশান্স পেতে আমাদের YouTube চ্যানেলটি SUBSCRIBE করতে পারো এই লিংক থেকে।
Discussion about this post