লাইব্রেরি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ২৫শে বৈশাখ ১২৬৮ সালে (৭ই মে ১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দ) কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর। বিদ্যালয়ের আনুষ্ঠানিক শিক্ষা তিনি লাভ করেননি, কিন্তু সাহিত্যের বিচিত্র ক্ষেত্রে তাঁর পদচারণা এক বিস্ময়ের বিষয়।
তিনি ছিলেন প্রকৃত অর্থেই অসামান্য প্রতিভাধর ব্যক্তি। বাল্যকালেই তাঁর কবিপ্রতিভার উন্মেষ ঘটে। মাত্র পনেরো বছর বয়সে তাঁর বনফুল কাব্য প্রকাশিত হয়। ১৯১৩ সালে রবীন্দ্রনাথ ইংরেজি Gitanjali : Song Offerings সংকলনের জন্য এশীয়দের মধ্যে সাহিত্যে প্রথম নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।
বস্তুত তাঁর একক সাধনায় বাংলা ভাষা ও সাহিত্য সকল শাখায় দ্রুত উন্নতি লাভ করে এবং বিশ্বদরবারে গৌরবের আসনে প্রতিষ্ঠিত হয়।
লাইব্রেরি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
তিনি একাধারে সাহিত্যিক, দার্শনিক, শিক্ষাবিদ, সুরকার, নাট্য প্রযোজক ও অভিনেতা। কাব্য, ছোটোগল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ, গান ইত্যাদি সাহিত্যের সকল শাখাই তাঁর অবদানে সমৃদ্ধ।
তাঁর অজস্র রচনার মধ্যে মানসী, সোনার তরী, চিত্রা, কল্পনা, ক্ষণিকা, বলাকা, পুনশ্চ, চোখের বালি, গোরা, ঘরে বাইরে, যোগাযোগ, শেষের কবিতা, বিসর্জন, ডাকঘর, রক্তকরবী, গল্পগুচ্ছ, বিচিত্র প্রবন্ধ ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ২২শে শ্রাবণ ১৩৪৮ সালে (৭ই আগস্ট ১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দ) কলকাতায় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
লাইব্রেরি পাঠ পরিচিতি
‘লাইব্রেরি’ প্রবন্ধটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিচিত্র প্রবন্ধ গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। এটি তাঁর বিচিত্র প্রবন্ধ গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত। এ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লাইব্রেরির গুরুত্ব তুলে ধরেছেন। তিনি লাইব্রেরিকে মহাসমুদ্রের কল্লোলধ্বনির সাথে তুলনা করেছেন। কেননা, লাইব্রেরিতে মানবাত্মার ধ্বনিরাশি বইয়ের পাতায় বন্দি হয়ে থাকে।
বইয়ের ভেতর দিয়েই আমরা আকাশের দৈববাণী থেকে মহাত্মাদের কথা পেয়ে থাকি। যাঁদের সান্নিধ্য আমাদের কখনই পাওয়া সম্ভব নয়, বইয়ের ভেতর দিয়েই আমরা তাদের পেতে পারি। বই আমাদের অতীতের সাথে সেতুবন্ধ গড়ে দেয়। এ বইয়ের স্থান হলো লাইব্রেরি। এ লাইব্রেরিতেই মানব হৃদয়ের উত্থান-পতনের শব্দ শোনা যায়।
লাইব্রেরিতে সকল পথের, সকল মতের মানুষের সম্মিলন ঘটে। লাইব্রেরির মহত্ত্বের কথা বর্ণনা করে লেখক বলেছেন- জগতের উদ্দেশ্যে কি আমাদেরও কিছু বলার নেই? আমরা কি কেবল তুচ্ছ বিষয় নিয়ে কলহ করে বেড়াব। লেখক শেষে আশা ব্যক্ত করে বলেছেন— বাঙালিরা জেগে উঠেছে।
তারাও আপন ভাষায় লিখে বিশ্বের জ্ঞানভাণ্ডার সমৃদ্ধ করে তুলবে। ‘লাইব্রেরি’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বই পড়ার সঙ্গে জ্ঞানের সম্পর্ক উপস্থাপন করেছেন। প্রবন্ধটি আমাদের বই পাঠ এবং জ্ঞানের প্রতি আগ্রহী করে তোলে।
লাইব্রেরি প্রবন্ধের শুরু এখানে
মহাসমুদ্রের শত বৎসরের কল্লোল কেহ যদি এমন করিয়া বাঁধিয়া রাখিতে পারিত যে, সে ঘুমাইয়া পড়া শিশুটির মতো চুপ করিয়া থাকিত, তবে সেই নীরব মহাশব্দের সহিত এই লাইব্রেরির তুলনা হইত। এখানে ভাষা চুপ করিয়া আছে, প্রবাহ স্থির হইয়া আছে, মানবাত্মার অমর আলোক কালো অক্ষরের শৃঙ্খলে কাগজের কারাগারে বাঁধা পড়িয়া আছে।
ইহারা সহসা যদি বিদ্রোহী হইয়া উঠে, নিস্তব্ধতা ভাঙিয়া ফেলে, অক্ষরের বেড়া দগ্ধ করিয়া একবারে বাহির হইয়া আসে! হিমালয়ের মাথার উপরে কঠিন বরফের মধ্যে যেমন কত কত বন্যা বাঁধা আছে, তেমনি এই লাইব্রেরির মধ্যে মানবহৃদয়ের বন্যা কে বাঁধিয়া রাখিয়াছে!
বিদ্যুৎকে মানুষ লোহার তার দিয়া বাঁধিয়াছে, কিন্তু কে জানিত মানুষ শব্দকে নিঃশব্দের মধ্যে বাঁধিতে পারিবে। কে জানিত সংগীতকে, হৃদয়ের আশাকে, জাগ্রত আত্মার আনন্দধ্বনিকে, আকাশের দৈববাণীকে সে কাগজে মুড়িয়া রাখিবে! কে জানিত মানুষ অতীতকে বর্তমানে বন্দি করিবে! অতলস্পর্শ কালসমুদ্রের উপর কেবল এক-একখানি বই দিয়া সাঁকো বাঁধিয়া দিবে!
লাইব্রেরির মধ্যে আমরা সহস্র পথের চৌমাথার উপরে দাঁড়াইয়া আছি। কোনো পথ অনন্ত সমুদ্রে গিয়াছে, কোনো পথ অনন্ত শিখরে উঠিয়াছে, কোনো পথ মানবহৃদয়ের অতলস্পর্শে নামিয়াছে। লাইব্রেরি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে যে- দিকে ধাবমান হও, কোথাও বাধা পাইবে না। মানুষ আপনার পরিত্রাণকে এতটুকু জাগয়ার মধ্যে বাঁধিয়া রাখিয়াছে।
শঙ্খের মধ্যে যেমন সমুদ্রের শব্দ শুনা যায়, তেমনি এই লাইব্রেরির মধ্যে কি হৃদয়ের উত্থানপতনের শব্দ শুনিতেছ? এখানে জীবিত ও মৃত ব্যক্তির হৃদয় পাশাপাশি এক পাড়ায় বাস করিতেছে। বাদ ও প্রতিবাদ এখানে দুই ভাইয়ের মতো একসঙ্গে থাকে। সংশয় ও বিশ্বাস, সন্ধান ও আবিষ্কার এখানে ‘দেহে দেহে লগ্ন হইয়া বাস করে।’ এখানে দীর্ঘপ্রাণ স্বল্পপ্রাণ পরম ধৈর্য ও শান্তির সহিত জীবনযাত্রা নির্বাহ করিতেছে, কেহ কাহাকেও উপেক্ষা করিতেছে না।
কত নদী সমুদ্র পর্বত উল্লঙ্ঘন করিয়া মানবের কণ্ঠ এখানে আসিয়া পৌছিয়াছে— কত শত বৎসরের প্রান্ত হইতে এই স্বর আসিতেছে। এসো এখানে এসো, এখানে আলোকের জন্মসংগীত গান হইতেছে।
লাইব্রেরি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
অমৃতলোক প্রথম আবিষ্কার করিয়া যে যে মহাপুরুষ যে-কোনোদিন আপনার চারিদিকে মানুষকে ডাক দিয়া বলিয়াছিলেন ‘তোমরা সকলে অমৃতের পুত্র, তোমরা দিব্যধামে বাস করিতেছ’ সেই মহাপুরুষদের কণ্ঠই সহস্র ভাষায় সহস্র বৎসরের মধ্য দিয়া এই লাইব্রেরির মধ্যে প্রতিধ্বনিত হইতেছে।
এই বঙ্গের প্রান্ত হইতে আমাদের কি কিছু বলিবার নাই? মানবসমাজকে আমাদের কি কোনো সংবাদ
দিবার নাই? জগতের একতান সংগীতের মধ্যে বঙ্গদেশই কেবল নিস্তব্ধ হইয়া থাকিবে !
আমাদের পদপ্রান্তস্থিত সমুদ্র কি আমাদিগকে কিছু বলিতেছে না? আমাদের গঙ্গা কি হিমালয়ের শিখর হইতে কৈলাসের কোনো গান বহন করিয়া আনিতেছে না? আমাদের মাথার উপরে কি তবে অনন্ত নীলাকাশ নাই? সেখান হইতে অনন্তকালের চিরজ্যোতির্ময়ী নক্ষত্রলিপি কি কেহ মুছিয়া ফেলিয়াছে ?
দেশ-বিদেশ হইতে অতীত-বর্তমান হইতে প্রতিদিন আমাদের কাছে মানবজাতির পত্র আসিতেছে; আমরা কি তাহার উত্তরে দুটি-চারটি চটি চটি ইংরেজি খবরের কাগজ লিখিব। সকল দেশ অসীম কালের পটে নিজ নিজ নাম খুদিতেছে। বাঙালির নাম কি কেবল দরখাস্তের দ্বিতীয় পাতেই লেখা থাকিবে!
জড় অদৃষ্টের সহিত মানবাত্মার সংগ্রাম চলিতেছে, সৈনিকদিগকে আহ্বান করিয়া পৃথিবীর দিকে দিকে শঙ্খধ্বনি বাজিয়া উঠিয়াছে, আমরা কি কেবল আমাদের উঠানের মাচার উপরকার লাউ-কুমড়া লইয়া মকদ্দমা এবং আপিল চালাইতে থাকিব।
বহু বৎসর নীরব থাকিয়া বঙ্গদেশের প্রাণ ভরিয়া উঠিয়াছে। তাহাকে আপনার ভাষায় একবার আপনার কথাটি বলিতে দাও। বাঙালি-কণ্ঠের সহিত মিলিয়া বিশ্বসংগীত মধুরতর হইয়া উঠিবে।
লাইব্রেরি প্রবন্ধের সৃজনশীল প্রশ্ন
একজনের পক্ষে সর্ববিদ্যাবিশারদ হওয়া অসম্ভব। সেজন্য একেকজন একেক বিষয়ে পারদর্শিতা লাভ করে। আবার যে-ব্যক্তি যে-বিদ্যায় পারদর্শিতা লাভ করে তার সবটুকু জ্ঞান মস্তিষ্কে ধারণ করাও একজনের পক্ষে সম্ভব হয় না। তাই প্রয়োজন এমন কোনো উপায় উদ্ভাবনের, যার বদৌলতে দরকার অনুযায়ী সমস্ত বিষয়ে একটা মোটামুটি জ্ঞান লাভ করা যায়। সেই থেকে প্রয়োজন দেখা দেয় জ্ঞান সংরক্ষণের।
ক. কীসের মধ্যে সমুদ্রের শব্দ শোনা যায়?
খ. ‘জীবিত ও মৃত ব্যক্তির হৃদয় পাশাপাশি এক পাড়ায় বাস করিতেছে’ কথাটি বুঝিয়ে বল।
গ. উদ্দীপকে বর্ণিত জ্ঞান সংরক্ষণের কারণটি ‘লাইব্রেরি’ প্রবন্ধের আলোকে তুলে ধর।
ঘ. “মানব হৃদয়ের বন্যাকে বেঁধে রাখার প্রয়োজনীয় দিকটিই যেন উদ্দীপকও ‘লাইব্রেরি’ প্রবন্ধের মূল বক্তব্য” – বিশ্লেষণ কর।
◉ আরও দেখুন: নবম-দশম শ্রেণির সকল গল্প-কবিতার CQ-MCQ সমাধান
শিক্ষার্থীরা, উপরে নবম-দশম শ্রেণির বাংলা বই থেকে লাইব্রেরি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রবন্ধটি আলোচনা করা হয়েছে। এই বইয়ের যে সৃজনশীল প্রশ্নগুলো রয়েছে, তার উত্তরও তোমরা কোর্সটিকায় পেয়ে যাবে। সৃজনশীল প্রশ্নের সমাধানের জন্য উপরের ‘সৃজনশীল সমাধান’ অপশনে ক্লিক করো।
Discussion about this post