ষষ্ঠ শ্রেণির বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় ৬ষ্ঠ অধ্যায় বাংলাদেশের পরিবেশ : মানুষ নিজস্ব পরিবেশে বাস করে। পরিবেশের প্রাকৃতিক উপাদান দ্বারা মানুষ প্রভাবিত হয়। সভ্যতার ধারাবাহিক পরিবর্তনে পরিবেশ ও মানুষের সম্পর্কের মধ্যেও পরিবর্তন এসেছে।
মানুষের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের ফলস্বরূপ পরিবেশগত বিভিন্ন সমস্যার উদ্ভব হয়েছে। পরিবেশও ভারসাম্য হারাচ্ছে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার্থে আমাদের পরিবেশগত সমস্যার প্রতিরোধে অনেক কিছু করণীয় রয়েছে।
মানুষ নিজস্ব পরিবেশে জীবনযাপন করে। তার জীবন পরিবেশের প্রাকৃতিক উপাদান দ্বারা প্রভাবিত হয়। প্রকৃতির চারটি মূল উপাদান হলো- মাটি, পানি, বায়ু এবং আলো। আলো ও তাপের প্রধান উৎস হলো সূর্য। মাটির উপর জন্মানো গাছপালা পানি, বায়ু, তাপ ও আলোর সাহায্যে বেড়ে উঠে। এসবের উপর নির্ভর করেই এ পৃথিবীতে মানুষের বসতি সম্ভব হয়েছে।
ষষ্ঠ শ্রেণির বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় ৬ষ্ঠ অধ্যায় বাংলাদেশের পরিবেশ
সৃষ্টির শুরুতে মানুষ প্রকৃতির উপর বেশি নির্ভরশীল ছিল। জীবনধারণের জন্য প্রকৃতি থেকেই সে সবকিছু সংগ্রহ করেছে। ঘরবাড়ি তৈরিতে প্রকৃতি থেকে প্রয়োজনীয় উপাদান নির্বাচন করেছে।
মাটিকে সে উৎপাদনের প্রধান ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে। মাটির উর্বরা শক্তির হ্রাস-বৃদ্ধি হয়, ক্ষয় আছে, তাতে যে খনিজ সম্পদ আছে সেগুলো হ্রাস পায়। বাকি তিনটি অর্থাৎ পানি, বাতাস ও তাপের হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটলে মানুষের পক্ষে বেঁচে থাকা কঠিন হয়।
মানুষ যখন থেকে চাষবাস করে স্থিতিবস্থায় এসেছে, তখন থেকেই প্রকৃতিকে জয় করার চেষ্টা চালিয়েছে। বনবাদাড় সাফ করে বড়ো এলাকা জুড়ে ফসলের ক্ষেত করেছে। ধান, গম, ভুট্টা আরও অনেক ফসল উৎপাদন করেছে। কিছু পশুকে পোষ মানিয়ে কাজে লাগিয়েছে।
বন্য-পশুর কোনোটিকে মেরে রান্না করে খেতে শিখেছে। আবার কোনোটিকে মেরে হয়ত চামড়াটি কাজে লাগিয়েছে। আত্মরক্ষার জন্য হিংস্র পশুকে হত্যাও করেছে। নিজের প্রয়োজনে আবার মানুষ কিছু গাছপালা রোপণ করেছে, যা তাকে বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা করে।
পরিবেশগত সমস্যা কারণ ও প্রভাব
মানুষ অত্যন্ত বুদ্ধিমান প্রাণী। বুদ্ধি খাটিয়ে নদীতে বাঁধ দিয়ে জমিতে সেচের ব্যবস্থা করেছে। পানির শক্তি কাজে লাগিয়ে কল চালিয়েছে। এভাবে ক্রমেই তার প্রয়োজন মতো সে প্রকৃতির উপর আধিপত্য বাড়িয়েছে। বড়ো বড়ো কলকারখানা বানিয়েছে, শহর গড়েছে, গাড়ি ও অন্যান্য যানবাহন চালাচ্ছে। শীতাতপ যন্ত্র বানিয়ে নিজের আরাম বাড়িয়েছে।
এসব মিলিয়ে নানা রকম শব্দও বাড়ছে। শব্দদূষণ মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। মানুষ বাড়তে থাকায়, আর সবার মধ্যে ভালো ও আরামে থাকার জন্য প্রতিযোগিতা শুরু হওয়ায় পরিবেশের উপর চাপ বাড়ছে।
বলা যায়, মাটি, পানি, বায়ু ও তাপের সাথে মানুষের জীবনযাপনের যে ভারসাম্য থাকা দরকার ছিল তা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ফলে পরিবেশও ভারসাম্য হারাচ্ছে। দূষণের কারণে ঢাকা শহরের অনেক শিশু শ্বাসকষ্টে ভুগছে। তাছাড়া হৃদরোগ, ক্যানসার, চর্মরোগ, নানা ধরনের অ্যালার্জি বাড়ছে।
ধীরে ধীরে বেড়ে যাওয়া জনসংখ্যার চাপ দেশের নগরগুলোতে বৃদ্ধি পাচ্ছে। নগর প্রয়োজনের অতিরিক্ত জনসংখ্যার বাসস্থানসহ অন্যান্য সুবিধা নিশ্চিত করতে পারে না। ফলে নগরে বস্তির সংখ্যা ক্রমাগত বৃদ্ধি পায়। এছাড়া বসতি ও শিল্প-কারখানা স্থাপনের প্রয়োজনে দেশের অনেক জলাভূমি তা ব্যবহারের ধ্বংস হয়ে যায়।
কখনো কখনো শিল্প কারখানার বর্জ্য নদীর পানিতে মিশ্রিত হয়ে বা বিষাক্ত ধোয়া বাতাসে মিশে যায় তা ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। এতে জলজ জীববৈচিত্র্য বিলুপ্ত হয়। বাংলাদেশের পাহাড়ি এলাকায় পাহাড়ের ঢালে এবং পাহাড়ের পাদদেশে ঘরবাড়ি নির্মাণের কারণে পাহাড় কাটা হয়। এছাড়া অনেক সময় ইটের ভাটার জন্যও পাহাড় কাটা হয়।
এগুলো সবই পরিবেশগত সমস্যার কারণ। পরিবেশগত বিভিন্ন উপাদানের বাহুল্যতার কারণে বায়ুমণ্ডলের উষ্ণতা বৃদ্ধি পায়। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পায়। এতে উপকূলীয় এলাকার অনেকে গৃহহীন হয়ে পরিবেশগত উদ্বাস্তু হয়ে যায়।
একই জমি বারবার চাষ হওয়ার ফলে জমির স্বাভাবিক উর্বরা শক্তি কমে যাচ্ছে। এখন মানুষ ভূমিতে জৈব সার ছাড়াও রাসায়নিক সার দিচ্ছে। সার তৈরি এবং কাপড়, ঔষধ, নানা সরঞ্জামসহ মানুষের বিপুল চাহিদা মেটাতে বেড়ে চলেছে কারখানা। এগুলো থেকে কালো ধোঁয়া, বিষাক্ত গ্যাস আর যে বর্জ্য বেরিয়ে আসছে তা পানি ও বায়ুকে দূষিত করছে। তাছাড়া এর প্রভাবে তাপমাত্রাও বেড়ে যাচ্ছে। তাপ বেড়ে যাওয়ায় জলবায়ু ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ছে। এর ফলে অতিবৃষ্টি, খরা, ঝড়, বন্যা হচ্ছে।
আবার মানুষ বেড়ে যাওয়ায় এবং তাদের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় গাছপালা কাটা পড়ছে, প্রাকৃতিক বন উজাড় হচ্ছে। তাতে ভূমিক্ষয় আর তাপবৃদ্ধি ঠেকানো যাচ্ছে না। এমনকি এসবের ফলে সূর্যের ক্ষতিকর অতি বেগুণি-রশ্মি ঠেকানোর জন্য পৃথিবীর মহাকাশে যে ওজোন স্তর আছে তাও ছিদ্র হয়ে যাচ্ছে। এর সাথে যুক্ত হচ্ছে এক ধীর ব্যবহার যোগ্য প্লাষ্টিকের ব্যবহার যা পরিবেশের স্থায়ী ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে
অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ | ষষ্ঠ শ্রেণির বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় ৬ষ্ঠ অধ্যায় বাংলাদেশের পরিবেশ
মানুষের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে উজাড় হয়ে যাচ্ছে অক্সিজেনের অফুরন্ত উৎস গাছপালা। নির্বিচারে বন-জঙ্গল ধ্বংস করার ফলে প্রতিনিয়ত কমে যাচ্ছে বাতাসে প্রত্যাশিত অক্সিজেনের পরিমাণ।
ঝুঁকিতে পড়ে যাচ্ছে প্রয়োজনীয় খাদ্য, ঔষধ, জ্বালানি ইত্যাদির জোগান। বাতাসে অক্সিজেনের ভারসাম্য বিঘ্নিত হওয়ায় স্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে নাইট্রোজেন, কার্বন-ডাই-অক্সাইডসহ উষ্ণতা বৃদ্ধিকারী নানা গ্যাসের পরিমাণ।
আমাদের আরাম-আয়েশ নিশ্চিত করতে একইভাবে আমরা নিঃশেষ করে চলেছি খনিজসম্পদ, পশু-পাখি, নদী-নালাসহ প্রকৃতির নানা উপাদান। বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে অনেক প্রজাতি যা কোনো না কোনোভাবে আমাদের টিকে থাকার লড়াইয়ে সহায়তা করত।
ক্রমাগত পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার ফলে দুই মেরুর বরফ গলে সমুদ্রের উচ্চতা বেড়ে যাচ্ছে। তাতে সমুদ্রের তীরবর্তী দেশগুলোর নিম্নাঞ্চল ডুবে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর আরও অনেক দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
বাংলাদেশের পরিবেশগত সমস্যার প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে করণীয়
পরিবেশগত সমস্যার কারণে বাংলাদেশের জনগণের নানা প্রকার সমস্যা হয়। এ রকম সমস্যা কি আমরা হতে দিতে পারি? এ বিষয়ে জাতিসংঘ থেকে অনেক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আমাদের সরকারও বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। আমাদের সবারই, এমনকি শিশুদেরও এ বিষয়ে সচেতন হতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, আমরা-
• অযথা গাছ কাটব না।
• ১ বার ব্যবহার যোগ্য প্লাস্টিক ব্যবহার বন্ধ করব।
• রিসাইক্লিং করা শুরু করব।
• যেখানে-সেখানে ময়লা ফেলব না।
• যেসব গাড়ি থেকে কালোধোঁয়া বের হয় সেগুলো চলাচল বন্ধ করার জন্য সচেতন করব।
• লোকালয়ের কাছে শিল্পকারখানা না গড়তে সচেতন করব।
• বাড়ির বর্জ্য যথাস্থানে ফেলব। নর্দমায় কখনো শক্ত বর্জ্য ফেলব না।
• অযথা মাইক বাজিয়ে শান্তি নষ্ট করব না।
• হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, গ্রন্থাগার ও অফিস এলাকায় শব্দদূষণ করব না।
• পাহাড় কাটব না।
• নদী, খাল, হ্রদ বা সমুদ্রসহ ছোটো-বড় কোনো জলাধারে ময়লা ফেলব না।
• বন, পাহাড়, নদীসহ কোনো প্রাকৃতিক সম্পদ নষ্ট করব না।
• গাছ লাগাব ও গাছের যত্ন নেব।
• প্রকৃতির কাছাকাছি থাকব।
• মানুষের সৃষ্ট পরিবেশ দূষণের কারণগুলো জানব ও প্রতিরোধের ব্যবস্থা নেব।
• উন্নয়নমূলক কাজে প্রকৃতি ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষাকে অগ্রাধিকার দেব।
• নিজের খাবার, পোশাক ও অন্যান্য জিনিস নির্বাচন ও ব্যবহারে পরিবেশের ভারসাম্যের কথা বিবেচনা করব।
বাংলাদেশের পরিবেশ অধ্যায়ের সৃজনশীল প্রশ্ন
১. চিত্রভিত্তিক উদ্দীপক
ক. আলো ও তাপের প্রধান উৎস কোনটি?
খ. মানুষ কীভাবে প্রকৃতির উপর আধিপত্য বাড়িয়েছে? ব্যাখ্যা কর।
গ. উপরের চিত্রে কোন সমস্যাটি ফুটে উঠেছে? ব্যাখ্যা কর।
ঘ. উক্ত সমস্যা সমাধানে তোমাদের মতো শিশুদের করণীয় সম্পর্কে আলোচনা কর।
২. বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মনির হোসেন ঢাকার অভিজাত এলাকায় একটি অত্যাধুনিক ফ্ল্যাটে বসবাস করেন। তার ছেলে-মেয়েরা বিনোদনের জন্য উচ্চ আওয়াজে গান শোনে, যা প্রায়ই তাদের প্রতিবেশীদের অসুবিধার সৃষ্টি করে। তার এপার্টমেন্ট ভবনে বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য রয়েছে নিজস্ব জেনারেটর।
ক. মানুষ কখন থেকে প্রকৃতিকে জয় করার চেষ্টা চালিয়েছে?
খ. প্রকৃতির মূল উপাদান কীভাবে মানুষের উপর প্রভাব ফেলে?
গ. মনির হোসেনের ব্যবহৃত বৈদ্যুতিক সরঞ্জামাদি পরিবেশে কি ধরনের সমস্যা সৃষ্টি করছে? বর্ণনা কর।
ঘ. উক্ত সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য তোমার কি কোনো দায়িত্ব আছে বলে মনে কর?
পাঠ্যপুস্তকের আলোকে মতামত দাও।
◉ আরও দেখুন: ষষ্ঠ শ্রেণির বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় সকল অধ্যায়ের CQ-MCQ সমাধান
শিক্ষার্থীরা, উপরে তোমাদের ষষ্ঠ শ্রেণির বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় ৬ষ্ঠ অধ্যায় বাংলাদেশের পরিবেশ আলোচনা করা হয়েছে। এই বইয়ের যে সৃজনশীল প্রশ্নগুলো রয়েছে, তার উত্তরও তোমরা কোর্সটিকায় পেয়ে যাবে। সৃজনশীল প্রশ্নের সমাধানের জন্য উপরের ‘সৃজনশীল সমাধান’ অপশনে ক্লিক করো।
Discussion about this post