সুখী মানুষ মমতাজউদ্দীন আহমদ : ‘সুখী মানুষ’ মমতাজউদদীন আহমদের একটি নাটিকা। এর দুটি মাত্র দৃশ্য। নাটিকাটির কাহিনিতে আছে, মানুষকে ঠকিয়ে, মানুষের মনে কষ্ট দিয়ে, ধনী হওয়া এক মোড়লের জীবনে শান্তি নেই। চিকিৎসক বলেছেন, কোনো সুখী মানুষের জামা গায়ে দিলে মোড়লের অসুস্থতা কেটে যাবে। কিন্তু পাঁচ গ্রাম খুঁজেও একজন সুখী মানুষ পাওয়া গেল না।
শেষে একজনকে পাওয়া গেল, যে নিজের শ্রমে উপার্জিত আয় দিয়ে কোনোভাবে জীবিকা নির্বাহ করে সুখে দিন কাটাচ্ছে। তার কোনো সম্পদ নেই, ফলে চোরের ভয় নেই। সুতরাং শান্তিতে ঘুমোনোর ব্যাপারে তার কোনো দুশ্চিন্তাও নেই। শেষ পর্যন্ত সুখী মানুষ একজন পাওয়া গেলেও দেখা গেল তার কোনো জামা নেই।
সুখী মানুষ মমতাজউদ্দীন আহমদ
সুতরাং মোড়লের সমস্যার সমাধান হলো না। নাটকের মূল বক্তব্য – সম্পদই অশান্তির কারণ। সুখ একটা আপেক্ষিক ব্যাপার। একজনের অনেক সম্পদ থেকেও সুখ নেই। আবার আরেকজনের কিছু না থাকলেও সে সুখী থাকতে পারে।
মমতাজউদদীন আহমদ পশ্চিমবঙ্গের মালদহ জেলায় ১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জনের পর তিনি সরকারি কলেজে দীর্ঘদিন অধ্যাপনা শেষে ১৯৯২ সালে অবসর গ্রহণ করেন। নাট্যকার ও নাট্যাভিনেতা হিসেবে তিনি বাংলাদেশে একজন খ্যাতিমান ব্যক্তিত্ব।
তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনা— নাটক : ‘স্বাধীনতা আমার স্বাধীনতা’, ‘রাজা অনুস্বারের পালা’, ‘সাত ঘাটের কানাকড়ি’, ‘আমাদের শহর’, ‘হাস্য লাস্য ভাষ্য’; প্রবন্ধ-গবেষণা : ‘বাংলাদেশের নাটকের ইতিবৃত্ত’, ‘বাংলাদেশের থিয়েটারের ইতিবৃত্ত’ ইত্যাদি। সাহিত্যে অবদানের জন্য তিনি শিশু একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, বাংলা একাডেমি পুরস্কার, একুশে পদকসহ বিভিন্ন পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। তিনি ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দের ২ রা জুন ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।
সুখী মানুষ নাটিকার শুরু এখানে
প্রথম দৃশ্য
[মোড়লের অসুখ। বিছানায় শুয়ে ছটফট করছে। কবিরাজ মোড়লের নাড়ি পরীক্ষা করছে। মোড়লের আত্মীয় হাসু মিয়া আর মোড়লের বিশ্বাসী চাকর রহমত আলী অসুখ নিয়ে কথা বলছে।]
হাসু : রহমত, ও রহমত আলী।
হাসু : রহমত, ও রহমত আলী।
হাসু : ভালো করে শোনো, ঐ কবিরাজ যতই নাড়ি দেখুক, তোমার মোড়লের নিস্তার নাই।
রহমত : অমন ভয় দেখাবেন না। তাহলে আমি হাউমাউ করে কাঁদতে লেগে যাব
হাসু : কাঁদ, মন উজাড় করে কাঁদ। তোমার মোড়ল একটা কঠিন লোক। আমাদের সুবর্ণপুরের মানুষকে বড় জ্বালিয়েছে। এর গরু কেড়ে, তার ধান লুট করে তোমার মোড়ল আজ ধনী। মানুষের কান্না দেখলে হাসে।
রহমত : আর আজে-বাজে কথা বলবেন না। আপনি বাড়ি যান!
কবিরাজ : এত কোলাহল করো না। আমি রোগীর নাড়ি পরীক্ষা করছি।
রহমত : ও কবিরাজ, নাড়ি কী বলছে! মোড়ল বাঁচবে তো !
কবিরাজ : মূর্খের মতো কথা বল না। মানুষ এবং প্রাণী অমর নয়। আমি যা বলি মনোযোগ দিয়ে তাই শ্রবণ কর।
হাসু : আমাকে বলুন। মোড়ল আমার মামাতো ভাই।
রহমত : মোড়ল আমার মনিব।
কবিরাজ : এই নিষ্ঠুর মোড়লকে যদি বাঁচাতে চাও, তাহলে একটি কঠিন কর্ম করতে হবে।
হাসু বাঘের চোখ আনতে হবে?
কবিরাজ : আরও কঠিন কাজ।
রহমত : হিমালয় পাহাড় তুলে আনব?
কবিরাজ : পাহাড়, সমুদ্র, চন্দ্র, নক্ষত্র কিছুই আনতে হবে না ৷
মোড়ল : আর সহ্য করতে পারছি না। জ্বলে গেল। হাড় ভেঙে গেল। আমাকে বাঁচাও।
কবিরাজ : শান্ত হও। ও রহমত, মোড়লের মুখে শরবত ঢেলে দাও।
(রহমত মোড়লকে শরবত দিচ্ছে।)
হাসু : ঐ মোড়ল জোর করে আমার মুরগি জবাই করে খেয়েছে। আমি আজ মুরগির দাম নিয়ে ছাড়ব।
মোড়ল : ভাই হাসু এদিকে এস, আমি সব দিয়ে দেব। আমাকে শান্তি এনে দাও।
কবিরাজ : মোড়ল, তুমি কি আর কোনোদিন মিথ্যা কথা বলবে?
মোড়ল : আর বলব না। এই তোমার মাথায় হাত রেখে প্রতিজ্ঞা করছি, আর কোনোদিন মানুষের ওপর জবরদস্তি করব না। আমাকে ভালো করে দাও।
কবিরাজ : লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু। আর কোনোদিন লোভ করবে?
মোড়ল : না। লোভ করব না, অত্যাচার করব না। আমাকে শান্তি দাও। সুখ দাও।
কবিরাজ : তাহলে মনের সুখে শুয়ে থাক, আমি ওষুধের কথা চিন্তা করি।
মোড়ল : সুখ কোথায় পাব? আমাকে সুখ এনে দাও।
হাসু : অন্যের মনে দুঃখ দিলে কোনোদিন সুখ পাবে না।
মোড়ল : আমার কত টাকা, কত বড় বাড়ি! আমার মনে দুঃখ কেন?
কবিরাজ : চুপ কর। যত কোলাহল করবে তত দুঃখ বাড়বে। সুখী মানুষ মমতাজউদ্দীন আহমদ হাসু এদিকে এস, আমার কথা শ্রবণ কর ৷ মোড়লের ব্যামো ভালো হতে পারে, যদি…
রহমত : যদি কী?
কবিরাজ : যদি আজ রাত্রির মধ্যেই-
হাসু : কী করতে হবে?
কবিরাজ : যদি একটি ফতুয়া সংগ্রহ করতে পার।
রহমত : ফতুয়া?
কবিরাজ : হ্যাঁ, জামা। এই জামা হবে একজন সুখী মানুষের। তার জামাটা মোড়লের গায়ে দিলে, তৎক্ষণাৎ তার হাড় মড়মড় রোগ ভালো হবে।
রহমত : এ তো খুব সোজা ওষুধ।
কবিরাজ : সোজা নয়, খুব কঠিন কাজ। যাও, সুখী মানুষকে খুঁজে দেখ। সুখী মানুষের জামা না হলে অসুখী মোড়ল বাঁচবে না।
মোড়ল : আমি বাঁচব। জামা এনে দাও, হাজার টাকা বখশিশ দেব।
(দ্বিতীয় দৃশ্য)
[বনের ধারে অন্ধকার রাত। চাঁদের ম্লান আলো। ছোট একটি কুঁড়েঘরের সামনে হাসু মিয়া ও রহমত গালে হাত দিয়ে ভাবছে।]
রহমত : কী তাজ্জব কথা, পাঁচ গ্রামে একজনও সুখী মানুষ পেলাম না। যাকেই ধরি, সেই বলে, না ভাই, আমি সুখী নই।
হাসু : আর তো সময় নাই ভাই, এখন বারোটা। সুখী মানুষ নাই, সুখী মানুষের জামাও নাই। মোড়ল তো তাহলে এবার মরবে।
রহমত : আহা রে, আমরা এখন কী করব! কোথায় একটা মানুষ পাব, যে কিনা—
হাসু : পাওয়া যাবে না। সুখী মানুষ পাওয়া যাবে না। সুখ বড় কঠিন জিনিস। এ দুনিয়াতে ধনী বলছে, আরও ধন দাও; ভিখারি বলছে, আরও ভিক্ষা দাও; পেটুক বলছে, আরও খাবার দাও। শুধু দাও আর দাও। সবাই অসুখী। কারও সুখ নেই।
রহমত : আমরাও বলছি, মোড়লের জন্য জামা দাও, আমাদের বখশিশ দাও। আমরাও অসুখী।
হাসু : চুপ চুপ! ঘরের মধ্যে কে যেন কথা বলছে।
রহমত : ভূত নাকি? চলেন, পালিয়ে যাই। ধরতে পারলে মাছভাজা করে খাবে।
হাসু : এই যে, ভাই। ঘরের মধ্যে কে কথা বলছ? বেরিয়ে এস।
রহমত : ভূতকে ডাকবেন না।
[ঘর থেকে একজন লোক বেরিয়ে এলো।]
লোক : তোমরা কে ভাই? কী চাও?
হাসু : আমরা খুব দুঃখী মানুষ। তুমি কে?
লোক : আমি একজন সুখী মানুষ।
হাসু : আঁ! তোমার কোনো দুঃখ নাই?
লোক : না। সারা দিন বনে বনে কাঠ কাটি। সেই কাঠ বাজারে বেচি। যা পাই, তাই দিয়ে চাল কিনি, ডাল কিনি। মনের সুখে খেয়ে-দেয়ে গান গাইতে গাইতে শুয়ে পড়ি। এক ঘুমেই রাত কাবার।
হাসু : বনের মধ্যে একলা ঘরে তোমার ভয় করে না? যদি চোর আসে?
লোক : চোর আমার কী চুরি করবে?
হাসু : তোমার সোনাদানা, জামাজুতা?
(লোকটি প্রাণখোলা হাসি হাসছে)
রহমত : হা হা করে পাগলের মতো হাসছ কেন ভাই!
লোক : তোমাদের কথা শুনে হাসছি। চোরকে তখন বলব, নিয়ে যাও, আমার যা কিছু আছে নিয়ে যাও।
হাসু : তুমি তাহলে সত্যিই সুখী মানুষ।
লোক : দুনিয়াতে আমার মতো সুখী কে? আমি সুখের রাজা। আমি মস্ত বড় বাদশা।
রহমত : ও বাদশা ভাই, তোমার গায়ের জামা কোথায়? ঘরের মধ্যে রেখেছ? তোমাকে একশ টাকা দেব। জামাটা নিয়ে এস।
লোক : জামা!
রহমত : জামা মানে জামা! এই যে, আমাদের এই জামার মতো জিনিস। তোমাকে পাঁচশ টাকা দেব। জামাটা নিয়ে এস, মোড়লের খুব কষ্ট হচ্ছে।
লোক : আমার তো কোনো জামা নাই ভাই!
হাসু : মিছে কথা বল না।
লোক : মিছে বলব কেন? আমার ঘরে কিছু নাই। সেই জন্যই তো আমি সুখী মানুষ।
সুখী মানুষ নাটিকার সৃজনশীল প্রশ্ন
১. জোবেদ আলী ইউনিয়ন পরিষদের একজন সদস্য। এই নিয়ে টানা পঞ্চম বারের মতো তিনি বিপুল ভোটে নির্বাচিত হলেন। হবেনই বা না কেন? এলাকার মানুষের অসুখ-বিসুখ হলে সুস্থ না হওয়া অবধি তিনি তার শয্যা ছাড়েন না। সমস্যায় পড়লে সমাধান নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত তার মুখে অনু রোচে না। সেই তার অসুখ হলে গাঁয়ের লোক ভেঙে পড়ল। চোখের পানিতে বুক ভাসিয়ে প্রার্থনা করল-আল্লাহ, তুমি আমাদের জোবেদ ভাইকে সুস্থ করে দাও।
ক. আয়ুর্বেদ শাস্ত্রমতে যাঁরা চিকিৎসা করেন তাঁদের কী বলে?
খ. হাসু মোড়লের মৃত্যুকামনা করে কেন?
গ. জোবেদ আলীর সঙ্গে ‘সুখী মানুষে’র যে মিল আছে তা ব্যাখ্যা করো।
ঘ. ‘মোড়ল যদি জোবেদ আলীর মতো হতেন তাহলে তার চিকিৎসার জন্য সুখী মানুষের জামা তালাশ করতে হতো না।’-বিশ্লেষণ করো।
২. সেলিম সাহেব নানা উপায়ে নানা পন্থায় সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন। নদীর পাড় ভেঙে পড়ার মতো ইদানিং বিভিন্ন অজুহাতে সে পাহাড়ের বিরাট বিরাট অংশ হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। রাতে দুশ্চিন্তায় ঘুম হয় না। তার মনে হচ্ছে যাকে তিনি এক সময় সুখের উৎস ভেবেছিলেন তাই হয়ে উঠেছে এখন অসুখের মূল কারণ। ভাঙন যেভাবে লেগেছে তাতে বোঝা যাচ্ছে পাপের ধন প্রায়শ্চিত্তেই যাবে।
ক. নাট্যকার মমতাজউদদীন আহমদের পেশাগত পরিচয় কী?
খ. হাসু মোড়লের আত্মীয় হওয়া সত্ত্বেও তার অকল্যাণ কামনা করে কেন?
গ. মোড়ল চরিত্রের সঙ্গে সেলিম সাহেবের চরিত্রের সাদৃশ্য ব্যাখ্যা করো।
ঘ. ‘মোড়ল আর সেলিম সাহেবের অসুখের মূল কারণ অভিন্ন সূত্রে গাঁথা।’- উক্তিটি বিশ্লেষণ করো।
◉ আরও দেখুন: অষ্টম শ্রেণির সকল গল্প-কবিতার CQ-MCQ সমাধান
শিক্ষার্থীরা, উপরে অষ্টম শ্রেণির বাংলা বই থেকে সুখী মানুষ মমতাজউদ্দীন আহমদ নাটিকাটি আলোচনা করা হয়েছে। এই বইয়ের যে সৃজনশীল প্রশ্নগুলো রয়েছে, তার উত্তরও তোমরা কোর্সটিকায় পেয়ে যাবে। সৃজনশীল প্রশ্নের সমাধানের জন্য উপরের ‘সৃজনশীল সমাধান’ অপশনে ক্লিক করো।
Discussion about this post