সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা, তোমাদের ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়টি অনুযায়ী আজকে আমরা ১০টি সামাজিক রীতিনীতি ও মূল্যবোধ নিয়ে আলোচনা করব। জাতি হিসেবে আমরা সাংস্কৃতিক দিক থেকে সমৃদ্ধ। তাই আমাদের আমাদের পরিবার, এলকা ও সমাজে বিভিন্ন রীতি-নীতি ও মূল্যবোধ প্রচলিত রয়েছে।
এসব রীতি-নীতি ও মূল্যবোধ আমাদের সমাজে শৃঙ্খলা তৈরি করে। আমরা শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করতে পারি। বিভিন্ন দেশের প্রচলিত রীতি-নীতির পেছনে ব্যক্তির এমন কিছু ধ্যান-ধারণা কাজ করে, যা সম্পূর্ণরূপে কাল্পনিক। আবার কিছু কিছু মূল্যবোধ মানুষের মঙ্গলের জন্য অনুসরণ করা হয়ে থাকে। আজকের এ আলোচনায় আমরা এমন ১০টি সামাজিক রীতিনীতি ও মূল্যবোধ জানতে চলেছি, যা তোমাদের ভাবিয়ে তুলবে।
১০টি সামাজিক রীতিনীতি ও মূল্যবোধ
আমরা এসব রীতি-নীতি ও মূল্যবোধগুলো আমাদের মা-বাবা এবং বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিদের থেকে পেয়ে থাকি। তারা নিজেরা এসব নিয়ম-কানুন মেনে চলেন এবং অন্যদেরও মেনে চলার পরামর্শ দেন। তারা মনে করেন, এসব নিয়ম-কানুন মেনে চললে সমাজে শৃঙ্খলা বজায় থাকে, সবার মধ্যে সম্প্রীতি বজায় থাকে।
এ নিয়মগুলো মেনে না চললে প্রচলিত কোন শাস্তির বিধান নেই। তবে সমাজের অধিকাংশ মানুষই এসব নিয়ম-কানুন না মানা মানুষদের অপছন্দ করেন। আর তাই আমাদের সমাজের সকল মানুষ এসব প্রচলিত রীতি-নীতিগুলো মেনে চলার চেষ্টা করেন।
১০টি সামাজিক রীতিনীতি
১. দাঁত পড়ে গেলে ইঁদুরের গর্তে ফেলা: আমাদের গ্রামীণ সমাজে শিশুর প্রথম দাঁত পড়া এবং তার প্রেক্ষিতে রীতি-নীতি পালনের পেছনে বিভিন্ন গল্প রয়েছে। বয়োজেষ্ঠ ব্যক্তিরা মনে করেন যে, শিশুর প্রথম পড়ে যাওয়া দাঁতটি ইঁদুরের গর্তে রাখলে উক্তর শিশুর নতুন দাঁতগুলো অনেক সুন্দর এবং মজবুত হবে।
অনেকে মনে করেন, দাঁত ইঁদুরে গর্তে রাখলে আমাদের দাঁতগুলো দেখতে ছোট-ছোট এবং সুন্দর হবে। আবার কারো মতে, দাঁত রোদে ফেলে দিলে আমাদের দাঁত অনেক উজ্জ্বল এবং পরিস্কার হবে। এ গল্পগুলো মূলত মনের কাল্পনিক কিছু ধারণা।
২. জিনিসপত্র ডান হাত দিয়ে দেওয়া-নেওয়া করা: আমাদের সমাজের বহুল প্রচলিত একটি রীতি হচ্ছে, কোনো জিনিসপত্র ডান হাত দিয়ে দেওয়া এবং ডান হাত দিয়েই নেওয়া। কেউ যদি বাম হাত দিয়ে কোনো কিছু দেওয়া-নেওয়া করে থাকে, তাহলে তা খুবই অশোভন মনে করা হয়। আর সমাজের মানুষজনও এমন কাজকে একদমই পছন্দ করেন না।
৩. বাসা থেকে বের হওয়ার সময় ডান পা আগে দেওয়া: বাসা থেকে বের হওয়ার সময় আমরা সব সময় ডান পা আগে বাড়াই। আমাদের মা-বাবা এবং অন্যান্য বয়োজ্যেষ্ঠ্য ব্যক্তিরাও এমন পরামর্শ দিয়ে থাকেন। মূলত এটি একটি সংস্কার, যা মানুষের কাজকে শোভন করে তোলে। আবার ডান পা আগে বাড়ানোটাকে অনেকে শুভ এবং মঙ্গলময়ও মনে করে থাকেন। বিশেষ করে ধর্মীয় দৃষ্টিকোন থেকে দেখতে গেলে, ইসলাম ধর্ম কোনো ভালো কাজের শুরুতে ডান হাত এবং ডান পায়ের ব্যবহারকে অগ্রাধিকার দেয়।
৪. টিকটিকি টিকটিক করে ওঠায় ৩ বার শব্দ করা: কোনও কথার মাঝখানে টিকটিকি ডেকে উঠলে মনে করা হয়, সে সময় ব্যক্তি যে কথা বলছেন, তা সঠিক। এটা মূলত একটি কু-সংস্কার, যা মানুষের মধ্যে রীতি হিসেবে কাজ করে। অনেক সময় প্রবীণ ব্যক্তিরা টিকটিকির টিকটিক ডাক শুনলে সাথে সাথে ৩বার ঠক ঠক (কোনো কিছুর সাথে আঙুল দিয়ে) শব্দ করেন।
৫. পরীক্ষার সময় ডিম-কলা না খাওয়া: ডিম আমাদের প্রোটিন দেয়, আর কলা দেয় ভিটামিন। কলা ও ডিম দুই মিলে আমাদের শরীরে গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টির ঘাটতি পূরণ করে। অথচ পরীক্ষার সময় এই ডিম কলাকেই অশুভ মনে করা হয়। আমাদের মা-চাচীরা পরীক্ষার সময় সন্তানদের ডিম খেতে দেন না। কারণ তারা মনে করেন, ডিম খেলে পরীক্ষায় শূন্য পাবে, আর কলা খেলে পরীক্ষায় এক পাবে। মূলত ডিমের আকৃতি শূন্য (০) এবং কলার আকৃতি এক (১) এর মত দেখতে হয় বলেই তারা এমনটি চিন্তা করে থাকেন।
৬. গর্ভবতী মায়েদের জমজ কলা খেতে না দেওয়া: আমাদের দেশে কিছু জায়গায় নারীদের গর্ভাবস্থায় জোড়া কলা বা জমজ কলা খেতে নিষেধ করা হয়। কিছু কিছু অঞ্চলের মানুষ বিশ্বাস করেন যে, গর্ভাবস্থায় কোন নারী যদি জোড়া কলা খায়, তাহলে তার জমজ সন্তান হবে। এই ভয়ে গর্ভবতী নারীরাও জোড়া কলা বা জমজ কলা এড়িয়ে চলেন। (প্রকৃতপক্ষে এর কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। এটা কেবলই একটি রীতি মাত্র।)
৭. বড়দের পায়ে হাত দিয়ে সালাম করা: আমাদের সমাজে বড়দের পায়ে সালাম করাকে ইতিবাচক সংস্কার হিসেবে দেখা হয়। অনেকে এটাকে আদব বলে মনে করে থাকেন। সাধারণত বড়দের পায়ে হাত দিয়ে সালাম বা প্রণাম করার মাধ্যমে দোয়া-আশীর্বাদ নেওয়া হয়ে থাকে। অনেকে এটাকে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও ইতিবাচক রীতি বলে জ্ঞান করেন।
৮. সন্ধ্যার পর খোলা চুলে বাইরে না বের হওয়া: আমাদের দেশে, বিশেষ করে গ্রামীণ সমাজে সন্ধ্যার পরে নারীদের খোলা চুলে বাইরে বের হতে নিষেধ করা হয়। সন্ধ্যার পরে খোলা চুলে বাইরে বের হওয়াকে অশুভ মনে করা হয়। মনে করা হয়, খোলা চুলে বাইরে বের হলে খারাপ আত্মা বা ভূত সঙ্গে আসবে। তাই নারীদের চুল খোলা না রেখে বরং মাথা ঢেকে বাইরে বের হওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়।
৯. শিশুদের কপালে ফোটা দেওয়া: আমাদের দেশে ছোট শিশুদের কপালে কালো কালি বা কাজল দিয়ে ফোটা দেওয়া হয়। এই ফোটা শুধু মেয়ে শিশুকেই না, ছেলে শিশুদেরও দেওয়া হয়। মনে করা হয়, শিশুদের কপালে ফোটা দিলে কোনো অশুভ শক্তি তাকে স্পর্শ করতে পারবে না। এছাড়াও কেউ অন্যদের কুদৃষ্টি বা খারাপ নজর থেকে রক্ষার করার জন্যও শিশুদের কপালে ফোটা দেওয়াকে কার্যকরী মনে করা হয়।
১০. ভাঙ্গা আয়নায় চেহারা না দেখা: ভাঙ্গা আয়নায় চেহারা দেখাকে অশুভ মনে করা হয়। অনেকে মনে করে থাকেন যে, ভাঙ্গা আয়নায় মুখ দেখলে অমঙ্গল হবে। আর এজন্য কোনো আয়না সামান্য একটু ভেঙে গেলেও সেটি ব্যবহার না করে বরং ফেলে দেওয়া হয়।
১০টি সামাজিক মূল্যবোধ
১. বড়দের সালাম দেওয়া: ইসলাম ধর্মে একে অপরের সাথে সাক্ষাতে সালাম বিনিময় করে থাকে। বিশেষ করে, আমাদের সমাজে বড়দের সালাম করাকে ইতিবাচক সংস্কার হিসেবে দেখা হয়। সালাম অর্থ শান্তি। মূলত সালাম দেওয়ার মাধ্যমে অপর ব্যক্তির কল্যাণ কামনা করা হয়ে থাকে। আমরা যখন কাউকে দেখব, সে বড় হোক বা ছোট, অবশ্যই সালাম দেব।
২. শিক্ষক ক্লাসে ঢুকলে দাঁড়িয়ে যাওয়া: ক্লাসে যখন শিক্ষক প্রবেশ করেন, তখন শিক্ষককে সম্মান প্রদর্শনের জন্য আমরা দাঁড়িয়ে যাই। আমরা সবাই শিক্ষককে সম্মান করি। কারণ, তারা মানুষ গড়ার কারিগর। মূলত শিক্ষকরা সমাজের সম্মানীয় ব্যক্তি। তাঁরা আমাদের শিক্ষাদান করেন। এ বিষয়গুলো বিবেচনা করে শিক্ষকের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্য এ রীতির প্রচলন করা হয়েছে।
৩. বন্ধুদের সাথে খাবার ভাগাভাগি করে খাওয়া: স্কুলে ক্লাস বিরতি বা টিফিনের সময় আমরা বন্ধু বা সহপাঠীদের সাথে খাবার ভাগাভাগি করে খেয়ে থাকি। এটা খুব ভালো একটি মূল্যবোধ। আমরা যদি আমাদের খাবারগুলো একে অন্যের সাথে ভাগাভাগি করি, তাহলে আমাদের মধ্যে সুন্দর বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে, ভ্রতৃত্বপূর্ণ এবং সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
৪. পথশিশুদের খাবার দেওয়া: পথশিশু বা ছিন্নমূল শিশুদের খাবার দেওয়া খুবই উত্তম এবং ইতিবাচক মূল্যবোধ। আমাদের আশেপাশে এমন অনেক শিশু রয়েছে, যাদের মা-বাবা নেই, পথে পথে ঘুরে বেড়ায়। এরা ঠিকমত খেতে পায় না, ভালো পোশাক পরতে পারে না। তাই আমাদের উচিত এদের যথাসম্ভব সাহায্য করা।
৫. দেশকে ভালোবাসা: যে দেশকে ভালোবাসে তাকে দেশপ্রেমিক বলা হয়। দেশের প্রতিটি নাগরিকের উচিত তার দেশকে নিজের জীবনের থেকেও অধিক ভালোবাসা। আমরা যদি দেশকে না ভালোবাসি, তাহলে নিজেদেরকে যোগ্য নাগরিক বলে দাবী করতে পারি না। তাই দেশকে ভালোবেশে, দেশের প্রতি অনুগত থেকে আমরা আমাদের রাষ্ট্রীয় মূল্যবোধকে জাগ্রত রাখব।
৬. অসহায়দের সাহায্য করা: আমাদের সমাজে সবার আর্থিক, সামাজিক অবস্থা এক রকম নয়। তাই আমাদের উচিত অসহায় দরিদ্রদের সাহায্য করা। এতে করে সমাজে মানুষের মধ্যে ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থানের সৃষ্টি হবে। আর ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও দুস্থ্য-অসহায়দের সাহায্য করা উত্তম গুণাবলীর মধ্যে অন্যতম।
৭. ঐক্যবদ্ধ থাকা: মানুষ সামাজিক জীব। তাই সমাজে বসবাস করতে গেলে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হয়। একতা ও সংহতি মেনে চললে মানুষ যেকোনো সমস্যা সবাই মিলে মোকাবিলা করতে পারে।
৮. অন্যের জিনিস অনুমতি ছাড়া না নেওয়া: অনুমতি ছাড়া অন্যের জিনিস নেওয়াকে চুরি বলে। এটা খুবই খারাপ একটি অভ্যাস। আমরা কখনোই না বলে কারো কোনো জিনিস নেব না। কারো কোনো জিনিস যদি আমাদের প্রয়োজন হয়ে থাকে, তাহলে অবশ্যই আমরা তার কাছে অনুমতি চাইব।
৯. পরিবারের অসুস্থ সদস্যদের সেবা করা: পরিবার প্রধানতম সামাজিক সংগঠন। পরিবার ছাড়া সমাজ কল্পনা করা যায় না। আমাদের পরিবারের কেউ অসুস্থ হলে আমাদের উচিৎ তাকে সেবা-শুশ্রুষার মাধ্যমে সুস্থ্য করে তোলা।
১০. নিয়মিত প্রার্থনা করা: মুসলিমরা নিয়মিত নামাজ আদায় করেন। হিন্দুরা পূজা-অর্চনার মাধ্যমে ঈশ্বরের সান্নিধ্য কামনা করেন। অন্যান্য ধর্মের মানুষেরা তাদের ধর্মীয় রীতি মেনে প্রার্থনায় অংশগ্রহণ করেন। মূলত ধর্মীয় প্রার্থনা আমাদের নানাবিধ খারাপ কাজ থেকে দূরে রাখে।
আরো দেখো: ৭ম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান সবগুলো অধ্যায়ের সমাধান
সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা, উপরে এতক্ষণ ১০টি সামাজিক রীতিনীতি ও মূল্যবোধ নিয়ে আমি আলোচনা করেছি। উপরে দেওয়া ‘উত্তরমালা’ অপশনে ক্লিক করে এই আলোচনাটি পিডিএফ আকারে সংগ্রহ করে নিতে পারো।
ডাউনলোড করতে অসুবিধা হলে আমাদের ফেসবুক পেজে ইনবক্স করো। শিক্ষার্থীরা অন্যান্য বিষয়ের নোট ও সাজেশান্স পেতে আমাদের YouTube চ্যানেলটি SUBSCRIBE করতে পারো এই লিংক থেকে।
Discussion about this post